চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে আবু সাঈদ হত্যা মামলার বিচার। তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য-জেরা শেষ হলেই শুরু হবে যুক্তিতর্ক, এরপর মামলাটি রায়ের দিকে অগ্রসর হবে। এ মামলায় প্রসিকিউশনের তালিকাভুক্ত ৬২ সাক্ষীর মধ্যে ২৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। সর্বশেষ সাক্ষ্য দেন মামলার প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা রুহুল আমিন। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ আসামির প্রত্যেকের ভূমিকা ও দায় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।
চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ প্রথম শহীদ হন। এ ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তাদের মধ্যে ছয়জন গ্রেপ্তার হলেও বাকি আসামিরা পলাতক রয়েছেন। গ্রেপ্তার ছয়জনের উপস্থিতিতেই সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।
২৫ নম্বর সাক্ষী হিসেবে তৃতীয় দিনের মতো সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) ট্রাইব্যুনাল-২–এ সাক্ষ্য দেন রুহুল আমিন। অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদের নেতৃত্বে দুই সদস্যের বিচারিক প্যানেল তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। প্যানেলের অপর সদস্য ছিলেন জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।
জবানবন্দিতে রুহুল আমিন তার তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ৩০ আসামির প্রত্যেকের ব্যক্তিগত দায় আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি প্রথমে বেরোবির তৎকালীন উপাচার্য হাসিবুর রশীদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। তদন্তে উঠে আসে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরোধিতায় অবস্থান নিয়ে তিনি অধীনস্তদের প্রশ্রয় দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির সভাপতি হয়েও অন্য আসামিদের বেআইনি কর্মকাণ্ড ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা নেননি। বরং আন্দোলন দমনে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় তিনি উসকানি ও সহযোগিতা করেন বলে সাক্ষ্যে উল্লেখ করা হয়।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) তৎকালীন কমিশনার মনিরুজ্জামান ওরফে বেল্টু। তিনি বেরোবি প্রশাসন ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদরর সহযোগিতা আর ইন্ধনে বেতারের (ওয়্যারলেস) মাধ্যমে পুলিশ কর্মকর্তাদের আবু সাঈদকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেন। ঘটনাটি ভিন্নখাতে নিতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাসহ ছাত্র-জনতাকে গ্রেপ্তার-নির্যাতনের মাধ্যমে হয়রানির পথ বাতলে দেন। একইসঙ্গে শহীদ আবু সাঈদের অসত্য সুরতহাল প্রস্তুত ও মিথ্যা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরিতে চাপ প্রয়োগ করেন। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেননি এই পুলিশ কর্মকর্তা।
আরএমপি কমিশনারের কথামতো সব বাস্তবায়ন করেন তৎকালীন উপ-পুলিশ কমিশনার আবু মারুফ হোসেন ওরফে টিটু। অন্য আসামিদের নিয়ে শহীদ আবু সাঈদের অসত্য ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিতে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে চাপ দেন তিনি। ঊর্ধ্বতন এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশ মেনে বেরোবি প্রশাসন ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ইন্ধন, উপস্থিতি আর সরাসরি সহযোগিতায় নিজের অধস্তনদের দিয়ে কাজ করান সাবেক অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার শাহ নূর আলম পাটোয়ারী ওরফে সুমন। অর্থাৎ আবু সাঈদকে হত্যার নির্দেশ দেন তিনি।
প্রায় একই নির্দেশ মানেন সাবেক সহকারী পুলিশ কমিশনার (কোতোয়ালি জোন) আরিফুজ্জামান ওরফে জীবন। আন্দোলন দমনে নিজ হাতেই গ্যাসগানে ফায়ার করেন তিনি। এছাড়া আবু সাঈদের অসত্য সুরতহাল প্রস্তুতে বাধ্য করেন। অন্য আসামিদের সঙ্গে তিনিও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন বদলাতে চাপ দেন চিকিৎসককে। তাজহাট থানার তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) রবিউল ইসলাম ওরফে নয়নের দায়ও অনেকটা কাছাকাছি। ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে মিথ্যা মামলাসহ গ্রেপ্তারপূর্বক ছাত্র-জনতাকে নির্যাতনের মাধ্যমে হয়রানি করেন। বিভূতি ভূষণ রায় ওরফে মাধবও আবু সাঈদকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যার উসকানি দেন। আন্দোলন চলাকালীন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্প ইনচার্জের (এসআই, নিরস্ত্র) দায়িত্বে ছিলেন তিনি। হয়রানি করেন নিরীহ ছাত্র-জনতাকেও।
এএসআই (সশস্ত্র) আমির হোসেন। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই দুপুর ২টা ১৭ মিনিটে আবু সাঈদকে হত্যা করেন তিনি। কোনো ধরনের হুমকি না থাকা সত্ত্বেও আরএমপি কমিশনার মনিরুজ্জামান গংদের অবৈধ নির্দেশে পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় নির্বিচারে গুলি চালান এই পুলিশ সদস্য। তাদের একই নির্দেশ বাস্তবায়ন করেন কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়।
বেরোবি প্রশাসনের ইন্ধন, উপস্থিতি ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ছাত্রলীগ সভাপতি পোমেল বড়ুয়াদের প্রশ্রয় দেন তৎকালীন প্রক্টর শরিফুল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির সদস্যসচিব পদে থেকেও বেআইনি কার্যক্রম প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেননি তিনি। বরং আন্দোলন দমনে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের উসকানি দেন। আবু সাঈদকে হত্যায়ও সহযোগিতা করেন। একই ধরনের কাজ করেন বেরোবির গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মশিউর রহমান, লোক প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান মণ্ডল ওরফে আসাদ, সহকারী রেজিস্ট্রার রাফিউল হাসান রাসেল, সহকারী রেজিস্ট্রার হাফিজুর রহমান ওরফে তুফান ও সেকশন অফিসার মো. মনিরুজ্জামান পলাশ। তারাও বেরোবি প্রশাসন ও পোমেল বড়ুয়া গংদের ইন্ধন, উপস্থিতি ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় উসকানিসহ সহযোগিতা করেন।
এ মামলার ১৬ নম্বর আসামি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া। তদন্তে উঠে এসেছে, ১১ জুলাই বেরোবির এক নম্বর গেটসংলগ্ন অভ্যন্তরীণ সড়কে ছাত্রলীগের সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান। এ সময় তিনি নিজ হাতে আবু সাঈদকে চড়-থাপ্পড় মারেন। পরে বেরোবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহাফুজুর রহমান শামীমসহ অন্যদের উপস্থিতি ও সরাসরি সহযোগিতায় ১৬ জুলাই আবু সাঈদকে হত্যার ঘটনায় অংশ নেন। মাহাফুজুর রহমান শামীমের দায়ও প্রায় একই ধরনের বলে তদন্তে উল্লেখ করা হয়।
তদন্ত কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, বেরোবি প্রশাসন ও পোমেল বড়ুয়ার নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একাধিক নেতা-কর্মী এ কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন সহ-সভাপতি ফজলে রাব্বী ওরফে গ্লোরিয়াস ফজলে রাব্বী, সহ-সভাপতি আখতার হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক সেজান আহম্মেদ ওরফে আরিফ, ধনঞ্জয় কুমার ওরফে টগর, দপ্তর সম্পাদক বাবুল হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইমরান চৌধুরী ওরফে আকাশ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদুল হাসান ওরফে মাসুদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএলএসএস মোহাম্মদ নুরুন্নবী মণ্ডল, সিকিউরিটি গার্ড নূর আলম মিয়া, অফিস সহকারী ও কম্পিউটার অপারেটর মাহাবুবার রহমান ওরফে বাবু, এমএলএসএস একেএম আমির হোসেন ওরফে আমু এবং প্রক্টর অফিসের চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী আনোয়ার পারভেজ।
এর মধ্যে ১১ জুলাই পোমেল বড়ুয়ার নেতৃত্বে বেরোবির এক নম্বর গেটের ভেতরের সড়কে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় সরাসরি অংশ নেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদুল হাসান। এ সময় তিনি আবু সাঈদের গলা চেপে ধরেন বলেও সাক্ষ্যে উল্লেখ করা হয়।
এ ছাড়া মামলার আরেক আসামি ডা. সারোয়াত হোসেন ওরফে চন্দন। রংপুরে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তদন্তে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আন্দোলন দমনে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের সহযোগিতা করেন তিনি। আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার পর ঘটনাটি ভিন্নখাতে নেওয়ার উদ্দেশ্যে মিথ্যা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরিতে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন এই চিকিৎসক নেতা।
এ মামলায় বর্তমানে ছয়জন গ্রেপ্তার রয়েছেন। তারা হলেন এএসআই আমির হোসেন, বেরোবির সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী, রাফিউল হাসান রাসেল এবং আনোয়ার পারভেজ। বাকি আসামিরা এখনও পলাতক। পলাতক আসামিদের পক্ষে সরকারি খরচে নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
কুশল/সাএ
সর্বশেষ খবর
আইন ও আদালত এর সর্বশেষ খবর