পালিয়ে এসেও দুর্বিষহ জীবন
আট সন্তানের (চার ছেলে, চার মেয়ে) পিতা আবু আহমাদের বয়স ৫২ বছর। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে সহিংসতা শুরু হওয়ার অল্প কিছুদিন আগে তার ১১ বছরের কন্যা রুকিয়া পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর, রুকিয়া কুতুপালং-এ এমএসএফ-এর ক্লিনিকে প্রায় ৭ মাস চিকিৎসা নেয়। সে তার শরীরের ঘা-এর চিকিৎসার জন্য কয়েকদিন পরপর এই ক্লিনিকে আসে।
এখানেই বিডি২৪লাইভের কক্সবাজারের বিশেষ প্রতিনিধি ওবাইদুল হক চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয় আবু আহমাদের। পরিবার নিয়ে পালিয়ে আসা, বাংলাদেশে তার পরিবারের জীবনযাত্রা এবং তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা-আশংকার কথা তুলে ধরেন আবু আহমাদ।
‘সংঘাতের আগে আমাদের গরু, ছাগল, জমি সবই ছিল। আমাদের ব্যবসা ও জীবিকা আমরাই চালাতাম। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের কাছ থেকে আমরা অনেক হুমকি ও অত্যাচারের মুখোমুখি হতাম। কেউ উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে চাইলে তাকে দেশ থেকে পালাতে হত, কারণ সরকার জানতে পারলে তাকে গ্রেফতার করত। আমাদের চলাচলের উপর অনেক নিষেধাজ্ঞা ছিল, আমরা চেকপোস্ট পার হতে পারতাম না। আমরা শুধু নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে চলাফেরা করতে পারতাম। অন্যান্যরা, যেমন বৌদ্ধ ও অন্য সম্প্রদায়ের লোক সব জায়গায় চলাচল করতে পারত।’
‘এরপর শুরু হয় সেই সহিংসতা। মারামারি, কাটাকাটি, বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়া। এর অল্প কয়েকদিন আগে আমার মেয়ে রুকিয়া পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রথমে ব্যাথার কথা বলত, পরে কোমরের নিচ থেকে অবশ হয়ে যায়। একরাতে আমি আমার সন্তানদের সাথে আলোচনা করতে বসি আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমরা কোন আশা দেখতে পাচ্ছিলাম না; আমরা যাই করি না কেন, হয় গ্রেফতার হব, বা মেরে ফেলা হবে। আমার বড় ছেলে বলল মারামারি শুরু হলে আমরা রুকিয়াকে নিয়ে দৌড়ে পালাতে পারব না।’
সে বলল, ‘তাকে বাঁচানোর কোন উপায় নেই। তুমি আর মা আগেভাগে তাকে বাংলাদেশ নিয়ে যাও। আমরা পরে তোমাদের সাথে একত্রিত হব।’
‘আমি আমার অন্য সন্তানদের প্রস্তুত হতে বললাম, আর আমার স্ত্রী ও আমি রুকিয়াকে নিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।’
মিয়ানমার থেকে পালানো
বাড়ি ছাড়ার পর আমরা গ্রাম থেকে বের হওয়ার কোন রাস্তা পাচ্ছিলাম না, কারণ যেদিকেই যাই দেখি সরকারি লোকজন অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুকিয়াকে বহন করার জন্য লোক ভাড়া করে আমরা মাইলের পর মাইল পাহাড়ের মধ্য দিয়ে পথ চলতে থাকি। অবশেষে রাতে আমরা বাংলাদেশের উল্টোদিকের তীরে পৌঁছাই। ততক্ষণে একটি নৌকার দেখা পাই, তীরে আমাদের সাথে আরও ২০ থেকে ৩০ জন মানুষ ছিল। মাঝি আমাদের সবাইকে নিরাপদে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। আমরা পৌঁছানোর পর দেখি বাংলাদেশের সীমান্ত বাহিনী অপেক্ষা করছে। তারা আমাদের অনেক সাহায্য করেছে; আমাদের খাবার, পানি, বিস্কিট দিয়ে তারা আমাদের সাহায্য করেছে। সকালে একটি বাস ভাড়া করে আমাদের কুতুপালং ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়।
বাস থেকে নামার পর আমি চিন্তিত হয়ে পড়ি। আমরা আগে কখনো বাংলাদেশে আসি নাই। আমি বুঝতে পারছিলাম না যে আমার অসুস্থ মেয়েটাকে কোথায় নিয়ে যাব, তাই আমি যাকে পাচ্ছিলাম তাকেই জিজ্ঞাসা করছিলাম। মানুষজন আমাদেরকে কুতুপালং-এ এমএসএফ-এর ক্লিনিকের কথা বলল। সেই ক্লিনিকের লোকজন রুকিয়াকে ভর্তি করল। সে প্রায় সাড়ে সাত মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তার এক্সরে করা হয়, ব্লাড ট্রান্সফিউশন করা হয়, এবং দিনে কয়েকবার ডাক্তার এসে দেখে যেত। আমাদের প্রতি বেলা খাবার দেয়া হত।
আমি যখন আমার স্ত্রী আর রুকিয়াকে নিয়ে রাখাইন ত্যাগ করি তখন অবস্থা এত খারাপ হয়নি। পরবর্তীতে অবস্থা এত খারাপ হয়ে উঠে যা আমাদের ধারণার বাইরে ছিল। কুতুপালং পৌঁছানোর পর আমার কাছে আমার সাত ছেলেমেয়ে, যাদেরকে ফেলে এসেছি, তাদের কোন খবর ছিল না। অন্যরা বলছিল যে আমাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং আমার ছেলেমেয়েরা পালিয়ে গেছে। আমাদের কাছে কোন ফোন ছিল না বা অন্য কোন মাধ্যমে আমার ছেলেমেয়েদের খোঁজ-খবর করার উপায়ও ছিল না; আমরা খুব চিন্তিত ছিলাম। কিছুদিন পর লোক মারফত জানতে পারলাম যে তারা বাংলাদেশে এসেছে এবং আমাদেরকে খুঁজছে। তারা কুতুপালং-এ আসে এবং মানুষজনকে রুকিয়ার কথা জিজ্ঞাসা করে করে এমএসএফ ক্লিনিকে আমাদের খুঁজে বের করে। প্রায় দুই মাস পরে যখন আমি আমার সন্তানদের সাথে এক হতে পারলাম তখন আবার শান্তি লাগলো। আমার সন্তানদের ফিরে পেয়ে আমার এত খুশি লাগলো, যেন আমি আমার পৃথিবী ফেরত পেয়েছি।
বাংলাদেশের দিনকাল
বাংলাদেশ সরকার আমাদের ঘর বানানোর জন্য কাঠ, বাঁশ ও প্লাস্টিকের শিট দিয়েছে। আমাদের বরাদ্দ অনুযায়ী তেল, চাল, ডাল দেয়। আমরা কিছু তেল ও ডাল বিক্রি করে দেই। এর পরিবর্তে মাছ, সবজি আর মরিচ কিনি। তেল, ডাল বিক্রি করে আমরা ১০০-২০০ টাকার মত পাই। টাকা না থাকলেও আমাদের বাঁচতে হবে। এই ১০০ বা ২০০ টাকা দিয়ে আমাদের এক মাস চলতে হয়। মাঝে মাঝে আমরা মাছ, সবজি খেতে পারি, মাঝে মাঝে পারি না। আমাদের কোন আয় নেই। যদি আমরা কাজ করতে পারতাম তাহলে আমাদের বেঁচে থাকা একটু সহজ হত। আমাদের সে রকম কোন সুযোগ নেই। আমার কাজ করার কোন সুযোগ নেই এবং আমার শরীরে শক্তিও নেই। আমি বাইরে কাজ করে আমার সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য আয় করতে পারি না।
ক্যাম্পে রুকিয়াকে নিয়ে থাকা কষ্টের। যেহেতু সে নাড়াচাড়া করতে পারে না, আমাদের কিছুদিন পরপরই তাকে নিয়ে ক্যাম্পের বাইরে হাসপাতালে যাওয়া আসা করতে হয়। আমাদের ঘর থেকে রাস্তার পথ কঠিন। ক্যাম্পে অনেক উঁচু-নিচু জায়গা আছে, আর আমাদেরকে তাকে কোলে করে নিয়ে চলতে হয়। এমএসএফ থেকে রুকিয়াকে যে হুইলচেয়ার দেয়া হয়েছে, সেটাকে প্রথমে আমি রাস্তায় রেখে আসি। তারপর তাকে কোলে করে রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যাই। তারপর হুইলচেয়ার ঠেলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। আমি ঘর বানানোর জন্য ক্যাম্পে কোন সমতল জায়গা পাইনি। যদি আমার কাছে টাকা থাকতো তাহলে আমি বাসে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারতাম আর আমার এত কষ্ট করতে হত না।
ক্লিনিকে অনেক পরীক্ষা ও চিকিৎসা করেছে, তারপরেও আমরা জানি না কেন রুকিয়া পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেল। আমি সবসময় আল্লাহ্র কাছে বলি সে যেন হাঁটতে পারে। মাঝে মাঝে সে আমাকে তাকে বিদেশ নিয়ে যেতে বলে যেন সে চিকিৎসা পায় আর লেখাপড়া করতে পারে। সে যখন এ রকম কথা বলে আমার তখন খারাপ লাগে। আমি আরও চিন্তিত হয়ে পড়ি এবং নিজের মধ্যে খুব চাপ অনুভব করি। আমার শক্তি আর কাজ করার সামর্থ্য শেষ। আমার সবসময় ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়। আমি খাবার, কাপড়, শান্তি আর আমাদের কষ্ট নিয়ে চিন্তা করি। আমার যদি আরও দশ বছর, পাঁচ বছর, চার বছর এমনকি যদি এক মাসও এখানে থাকতে হয়, আমাকে এই কষ্ট ভোগ করতেই হবে।
রুকিয়া যদি চলাফেরা করতে পারত তাহলে সে আরও সুখী হত। সে আমাকে হুইলচেয়ারে করে তাকে ঘুরাতে বলে, কিন্তু ক্যাম্প এত খাড়া যে আমি পারি না। হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে এই খাড়া ক্যাম্পে ঘোরা অনেক কষ্টের। আমার শরীরে এমনিতেই অনেক ব্যাথা, কারণ রুকিয়াকে আমার সব জায়গায় বয়ে নিয়ে যেতে হয়।
আমরা বার্মা (মিয়ানমার) থেকেই এসেছি, আমরা ফিরে যাব
আমরা দেশহীন না, আমরা বার্মা (মিয়ানমার) থেকে এসেছি। আমাদের পূর্বসূরীরা সেখানকার; আমাদের দাদাদের জন্ম সেখানে। যে দেশের সাথে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক আছে সেটি হল বার্মা (মিয়ানমার)। দেশে শান্তি আসলে আমরা ফিরে যাব, কিন্তু কিছু শর্তসাপেক্ষে। আমরা ফিরে যাব যদি আমরা আমাদের স্বাধীনতা ফিরে পাই; আমাদের বাড়িঘর, জমি, গরু-ছাগল যদি ফিরিয়ে দেয়া হয়। এক দেশের মানুষ অন্য দেশে থাকেতে পারে না। আল্লাহ আমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন, তিনি চাইলেই আমাদেরকে আমদের বাড়িঘর, আমাদের দেশে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে প্রস্তুত, কিন্তু এই সহিংস সংঘাতের পরিস্থিতির মধ্যে কিভাবে আমরা ফিরে যাব?
বিডি২৪লাইভ/ওয়াইএ
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]
পাঠকের মন্তব্য: