ইভিএম নিয়ে খোদ ইসিতে মতবিরোধ

প্রকাশিত: ২৯ আগষ্ট ২০১৮, ০৯:৪৭ এএম

একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে খোদ নির্বাচন কমিশনাররা মতবিরোধে জানিয়েছেন। নির্বাচনে ইভিএম ব্যহরের জন্য ৩৮২৯ কোটি টাকার নতুন যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কেও জানেন না পাঁচ কমিশনারের মধ্যে তিনজন।

এর মধ্যে এক কমিশনার সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য যে আরপিও সংশোধনের উদ্দ্যেগ নিয়েছিল সে বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে ‘নোট আব ডিসেন্ট দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অন্যদিকে ইসি জানিয়েছে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে সংসদ নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য যে পরিকল্পনা করে মন্ত্রণালয়ে ৩৮২৯ কোটি টাকার নতুন যে প্রকল্প পাঠানো হয়েছে সে বিষয়ে আমাকে কিছুই জানানো হয়নি। আপনাদের কাছে জানতে পারলাম। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে বিস্তারিত জানাতে পারব। সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে আরপিও সংশোধনের জন্য ৩০ আগস্ট মিটিং আছে সেখানে বিষটি জানতে চাইব।’

‘আমি এর আগে জানতাম সংসদ নির্বাচনে অল্প কিছু কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার হবে। বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে কিছু জানতাম না।’

নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ইভিএম প্রকল্পের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। সচিব এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানেন। যখন এগুলো ব্যবহার করার জন্য কমিশন সভায় আলোচনা হবে তখন বলব। এর আগে বিষয়টি নিয়ে বলার কিছু নেই, আমি বলতেও চাই না।’

কমিশনার কবিতা খানম বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে হলে তা আরপিওতে সংযুক্ত করতে হবে। তার পর কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করবে কিনা। ব্যবহার করলেও তা কতটুকু পরিসরে ব্যবহার করা হবে, সে ব্যাপারেও ৩০ আগস্ট সিদ্ধান্ত নিবে। ইভিএম কেনার নতুন প্রকল্পের বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’

সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে আরপিও সংশোধন করা হচ্ছে সে বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে একজন কমিশনার ‘নোট আব ডিসেন্ট’ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

তিনি নোটে বলেছেন, ‘বিগত ২৬ আগস্ট আরপিও সংশোধনের জন্য কমিশন সভায় তিন ধরনের প্রস্তাব উপস্থাপন করেন সেদিন দুটি প্রস্তাব দিয়ে কেবল একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনার সীমাবদ্ধ রাখা হয়। পরবর্তিতে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত কমিশন সভা মুলতবি করা হয়। স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ইতিমধ্যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে রাজনৈতিক দল ভোটারদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।’

নোটে তিনি আরও লিখেন, ‘প্রধান নির্বাচন কশিমনার প্রথম থেকে বলে আসছেন রাজনৈতিক দল গুলো সম্মত হলে সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে। সরকারের পক্ষ থেকে স্বাগত জানালেও বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ থেকে বিরোধীতা করা হয়েছে। তাই একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে অধিকতর আলোচনা করার প্রয়োজন ছিল।’

তিনি বলেন, ‘এর আগে ৫০ কোটি টাকার ইভিএম ক্রয়ের নথিতে আমি ভিন্নমত প্রকাশ করেছিলাম। সম্প্রতি ইভিএমের জন্য যে প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। কোন কোন রাজনৈতিক দলের বিরোধীতার মুখে আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার যেখানে অনিশ্চিত সেখানে এমন বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ক্রয় করা কতটা যুক্তিক।’

ইসি সূত্র জানায়, ইসি যে চাহিদা পত্র দিয়েছে তাতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৩০০ আসনে ইভিএম প্রয়োজন ২ লাখ ৬৪ হাজার। ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে একসঙ্গে ভোটগ্রহণ করতে গেলে ইভিএম প্রয়োজন ২৩ হাজার। একইভাবে দেশের ১১ সিটিতে একসঙ্গে ভোটগ্রহণ করতে গেলে ইভিএম লাগবে ৩৫ হাজার। ৩২৩ পৌরসভায় এ পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ করতে হলে ইভিএম লাগবে ৩৫ হাজার।

ইসির তথ্য অনুসারে, দেশে ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা ৪ হাজার ৫৫৫টি। এসব ইউপিতে একসঙ্গে ভোটগ্রহণ করতে ইভিএম লাগবে ৩ লাখ ১৮ হাজার ৫০০টি। তবে এ ক্ষেত্রে ইসি ভিন্ন পরিকল্পনা করেছে। পর্যালোচনাপত্রে উল্লেখ করা হয়, ইউপি নির্বাচন কয়েক ধাপে অনুষ্ঠিত হয়। ইতোপূর্বে প্রতিটি ধাপে সর্বোচ্চ ৭৫০টির মতো ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে একেক ধাপে ইভিএম প্রয়োজন ৫২ হাজার ৫০০।

এদিকে ৩৮২৯ কোটি টাকার ইভিএম প্রকল্প গ্রহণের প্রস্তাবটি সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটির বেশ কিছু বিষয় স্পষ্ট করার জন্য পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ণ কমিটি (পিইসি) মতামত দিয়েছে। গত ১৯ আগস্ট পিইসির সভায় এ মতামত দেয়া হয়। সম্প্রতি ‘নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় অধিকতর স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ক্রয়, সংরক্ষণ ও ব্যবহার’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

রাজনৈতিক ল গুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে ইসি। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ১৯ আগস্টের সভাটি বিশেষ কিছু কারণে মুলতবি করা হয়েছে। পিইসির সভায় প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে মর্মে মতামত এসেছে। প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে আলোচনার তাগিদ দিয়েছে পিইসি। প্রকল্পে ২০৪ জন পরামর্শকের প্রয়োজনীয়তা জানতে চেয়েছে পিইসি।

এক্ষেত্রে পরামর্শকের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও কর্মপরিধি ডিপিপিতে উল্লেখের জন্য বলা হয়েছে। প্রকল্পে ৩১১০ জনের প্রশিক্ষণের কথা উল্লেখ থাকলেও তারা কারা সে বিষয়ে উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া ৩০ জনকে বিদেশে প্রশিক্ষণ প্রদানের কথা বলা হলেও তাদের পরিচয় জানানো হয়নি। প্রকল্পে বিজ্ঞাপন প্রচার, পরিবহন, মোটরযানবাহন ক্রয়, কম্পিউটার সফটওয়্যার, আসবাবপত্র ক্রয় বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যায়ের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে আরও জানা গেছে, ইসির সঙ্গে সংলাপে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে সীমিত পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। বাড়তি জনবল, খরচ ও সময় বেশি লাগার কারণে এসব নির্বাচনে নানা সমালোচনা সৃষ্টি হয়।

এর আগেও ২০১৩ সালে সিটি নির্বাচনে বুয়েটের তৈরি ইভিএমে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে রাজশাহী সিটির পিটিআই কেন্দ্রে রণক্ষেত্র তৈরি হয়। ইভিএমের কারণে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া বিতর্কিত হয়ে পড়ে। সর্বপ্রথম এক এগারোর সময়কার এটিএম শামসুল হুদা কমিশন স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএমের প্রচলন ঘটায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর সহায়তায় প্রথমে ২০১০ সালে এ প্রযুক্তির ৫৩০টি মেশিন কেনা হয়। ব্যবহার করতে গিয়ে ইভিএমে নানা যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। পরে ২০১১ সালে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) প্রস্তুত করা ৭০০ ইভিএম কেনা হয়। এগুলোও পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত ছিল না।

বিডি২৪লাইভ/ওয়াইএ

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: