টাকার ওপর ঘুমাতেন তিনি!

প্রকাশিত: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৪:৪৫ পিএম

বাসার খাটের নিচে কোটি কোটি টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণবার রেখে এখন দেশজুড়ে আলোচনায় যশোরের শেখপাড়ার এসকে মো. আলী। পল্টনের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে টাকা ও বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে তোশক ও লেপ তৈরি করে ঘুমাতেন তিনি! দৃশ্যমান ব্যবসা বলতে তার আছে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে মিষ্টির দোকান। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম 'আলী সুইটস'। যদিও দাবি করেন, ডেভেলপার ব্যবসার সঙ্গে তিনি জড়িত। তবে মিষ্টি ব্যবসায়ী আলীর ধনকুবের হয়ে ওঠার কাহিনীও চমকপ্রদ। হুন্ডি আর চোরাই স্বর্ণের ব্যবসা করেই রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। 

শুধু আলী নন, চোরাই স্বর্ণ ব্যবসার সঙ্গে তার বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে আছেন সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং ডিবির যৌথ অভিযানে আলীর বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া ৬১ কেজি ৫৩৮ গ্রাম ওজনের ৫২৮টি স্বর্ণবার তার নয় বলে জানান তিনি। আলী জানান, এসব রিয়াজ উদ্দিনের। সমকালের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে_ ব্যাংক কর্মচারী থেকে অল্প দিনে কোটিপতি হয়েছেন রিয়াজ। এরপর উপজেলা চেয়ারম্যান হন। নিজ এলাকায় রিয়াজ এক 'রহস্যপুরুষ' হিসেবে পরিচিত। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, রিয়াজ ও আলী একই সিন্ডিকেটের সদস্য।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর পুরানা পল্টনের ২৯/১ নম্বর বাসা 'ঠিকানা'র ছয়তলায় একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও স্বর্ণ পাওয়া যায়। যার মোট পরিমাণ আট কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা মূল্যের সৌদি রিয়াল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার মধ্যরাত পর্যন্ত টাকা ও বিদেশি মুদ্রা গোনা সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে এক হাজার টাকার বান্ডেল ৩৪৮টি, ৫০০ টাকার বান্ডেল ৩৫৩টি, ১০০ টাকার বান্ডেল ১৪টি ও বাকিগুলো সৌদি রিয়ালের বান্ডেল। এ ছাড়া উদ্ধার করা স্বর্ণের দাম প্রায় ৩০ কোটি টাকা।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান সমকালকে বলেন, স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসার গডফাদার আলী। একাধিক সহযোগীর মাধ্যমে তিনি দীর্ঘ দিন ধরে অবৈধ কারবার চালিয়ে আসছিলেন। সহযোগী হিসেবে যাদের নাম আলী জানিয়েছেন তাদেরও মামলায় আসামি করা হবে। তিনটি ধারায় শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ এই মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিটি মুদ্রা ও টাকার নম্বর লিখে রাখার জন্য ম্যানুয়ালি তা গোনা হচ্ছে।

মইনুল খান আরও বলেন, দুবাই থেকে চোরাচালানকৃত স্বর্ণের সব বারের ওজন প্রতিটি দশ তোলা। আলীর বাসা থেকে প্রতিটি দশ তোলা ওজনের ৫২৮টি স্বর্ণবার পাওয়া গেছে। স্বর্ণের সব বার বিদেশি হলোগ্রামযুক্ত। তাছাড়া এর আগে বিভিন্ন সময় কালো কাপড় ও স্কচটেপে যেভাবে চোরাচালানের স্বর্ণ পাওয়া যায়, একই কায়দায় আলীর বাসায় স্বর্ণ ছিল।

সম্প্রতি স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশ বিমানের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গোয়েন্দারা গ্রেফতার করে। গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা মোহাম্মদ আলীর নাম প্রকাশ করেন। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর তখন থেকেই মোহাম্মদ আলীর ওপর নজরদারি শুরু করে। অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে বৃহস্পতিবার শুল্ক গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন যে, মোহাম্মদ আলীর বাসায় টাকা ও স্বর্ণের মজুদ রয়েছে। তারপরই সেখানে অভিযান চালানো হয়। মোহাম্মদ আলী অনেক বছর ধরেই হুন্ডি ব্যবসা ও স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বলে অধিদপ্তরের গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। গ্রেফতার বাংলাদেশ বিমানের ডিজিএম এমদাদ হোসেন, ক্যাপ্টেন আবু মোহাম্মদ আসলাম শহীদ, বিমানের সিডিউল ইনচার্জ তোজাম্মেল হোসেন এবং বিমানের ঠিকাদার মাহমুদুল হক পলাশের সঙ্গে মোহাম্মদ আলীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথাও জানা গেছে। এর সূত্র ধরেই মোহাম্মদ আলী ছোট ছোট চালানে বিদেশ থেকে স্বর্ণের বার নিয়ে আসতেন। স্বর্ণ এনে তার পল্টনের বাসায় মজুদ করতেন। আলী হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত। আলী বিভিন্ন সময় দুবাই যাওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন। বেনামে তার একাধিক পাসপোর্ট থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দারা।

উদ্ধার করা বিদেশি মুদ্রা ও টাকা গুনতে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের ২৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়। বৃহস্পতিবার রাত ৮টা থেকে শুক্রবার মধ্যরাত পর্যন্ত টাকা গোনা সম্পন্ন হয়। টাকা গণনার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন সমকালকে বলেন, এত টাকা জীবনে দেখেননি। টাকা গুনতে গুনতে তাদের আঙুল ব্যথা হয়ে গেছে।

এদিকে আলীর স্বীকারোক্তিতে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিনের নাম আসায় সন্দেহের তীর এখন তার দিকে। আশির দশকের এক ব্যাংক কর্মচারী রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার বিষয় নিয়ে নানা ধরনের গুঞ্জন ও কাহিনী আছে। তিনি সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করে দ্রুত সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পান। জেলা আওয়ামী লীগ থেকে তাকে গত ২৯ জানুয়ারির নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়।

জানা গেছে, জেলার সদর উপজেলার বাগবাটি ইউনিয়নের হরিণা গ্রামে বিশাল বাগানবাড়ির মালিক রিয়াজ উদ্দিন। ১৯৮৫ সালে জনতা ব্যাংকে ক্লার্ক পদে ঢাকার পল্টন শাখায় তার প্রথম নিয়োগ। এরই মধ্যে বিমানবন্দর ও মতিঝিল শাখায় বদলি হওয়ার সুবাদে তার অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে সখ্য হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনভাবে নিটিং অ্যান্ড ডাইং ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এ ব্যবসা গুটিয়ে তিনি বিভিন্ন দপ্তরে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে 'চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির' মাধ্যমে শহর রক্ষা বাঁধ ও যমুনায় ক্রসবার বাঁধের সংস্কার কাজের সাব-ঠিকাদারি কাজের একাংশের দায়িত্ব নিয়েছেন। দু'তিন বছর আগে ঢাকা থেকে এসে সিরাজগঞ্জে নিয়মিত থাকছেন রিয়াজ উদ্দিন। 

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগেই শহরের দ্বিধানগড়ায় একটি টিনশেড ভবন গড়ে বাস করছেন। এ অঞ্চলে দিন দিন তার রাজনৈতিক আধিপত্যও বাড়ছে। অভিযোগের ব্যাপারে সিরাজগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন শুক্রবার বিকেলে সমকালকে বলেন, 'স্বর্ণের মালিক তো দূরের কথা, মোহাম্মদ আলীকেই আমি চিনি না। এটা ষড়যন্ত্র। পাওয়ার লুম কারখানা ছাড়াও টুকটাক ঠিকাদারির সঙ্গে জড়িত আছি। খুব শিগগির সংবাদ সম্মেলনে ষড়যন্ত্রের জবাব দেওয়া হবে।'  সূত্র: সমকাল

বিডি২৪লাইভ/এমআর

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: