আরপিওকে অস্ত্রে পরিণত করতে চাচ্ছে সরকার

প্রকাশিত: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৭:৫০ পিএম

তড়িঘড়ি করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও) সংশোধনের মাধ্যমে সরকার নির্বাচনী আইনকে অস্ত্রে পরিণত করতে চাচ্ছে বলে সন্দেহ পোষণ করছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা। তারা মনে করছেন, বিদ্যমান আইন প্রয়োগের প্রতি নির্বাচন কমিশনের কোন ভ্রক্ষেপ নেই। তার ওপর ইভিএম ব্যবহারের প্রতি নির্বাচন কমিশন উৎসাহ দেখাচ্ছে। এজন্য তারা দ্রুত আইন সংশোধন করছে। এতে করে মনে হচ্ছে আইনটি অস্ত্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা চলছে।

রোববার (১৬ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিকরা এসব কথা বলেন। বৈঠকে তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, আমরা মনে করি, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য আরপিও-সহ বিভিন্ন আইনের সংশোধন হওয়া দরকার। কিন্তু সেগুলো হওয়া উচিৎ রাজনৈতিক দল-সহ সংশিষ্টদের সাথে মতামতের ভিত্তিতে।

কিন্তু আমরা দেখলাম নির্বাচন কমিশন হঠাৎ করে নির্বাচনে ইভিএম-এর প্রয়োগ নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। অথচ অনেক দেশই ইভিএম প্রয়োগ থেকে সরে এসেছে। তাই এখনই এবং বৃহৎ পরিসরে ইভিএম প্রয়োগ থেকে বিরত থাকা উচিৎ। এটি প্রয়োগ করতে হলে এর কারিগরি দিক নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া দরকার এবং এ বিষয়ে
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হওয়া দরকার। তিনি আরও বলেন, আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে ভেঙে পড়ছে, যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া দরকার। দলীয় সরকারের অধীনে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না, এর বিরুদ্ধেও সোচ্চার হওয়া দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সুষ্ঠু তথা জেনুইন নির্বাচন আয়োজন করতে আমরা সাংবিধানিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা জানি, সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি নির্ভর করে একটি যথাযথ নির্বাচনী আইন ও এর কঠোর প্রয়োগের ওপর।

আমরা দেখতে পেয়েছি যে, নির্বাচন কমিশন ইভিএম-সহ অনেকগুলো বিষয়ে সংশিষ্ট স্টেকহোল্ডারের মতামত উপেক্ষা করে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে না জানিয়ে আরপিওতে সংশোধনী আনার জন্য কতগুলো প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছে। তাই নির্বাচনে জিতে আসতে সরকার ‘উইপেনাইংজিং অব লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক'’ বা আইনের অস্ত্রীকরণ করছে কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন শিথিল করা দরকার, যাতে গণসংহতির মত সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক মত দল নিবন্ধন পেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সরকার চাইলেই কেবল সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্ভব। অর্থাৎ সরকার চাইলে প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকারকে সহায়তা করতে বাধ্য হবে। স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের জন্য ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরের বিধান তুলে দেয়া দরকার।

সিটি নির্বাচনগুলো সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। আলী ইমাম মজুমদার মনে করেন, সরকার চাইলেই শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। এ সময় তিনি উদাহরণ হিসেবে বলেন, বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ১৯৯৬ সালে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক ছিলেন। ওনার দ্বারা ১৯৯৬-এর ১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হয়েছে আবার ৯৬ সালের জুনের নির্বাচনও হয়েছে। আসলে সরকার চেয়েছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।

সুজনের নির্বাহী সদস্য সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা নাগরিকেরা যেন ভোট দিতে পারি সেই নিশ্চয়তা চাই। আমরা মনে করি, সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া যেমন দরকার, একইসঙ্গে দরকার শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ও ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়ন করা। আমরা মনে করি, সভ্য সমাজে সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস থাকতেই হবে। ভোট এখন আর চুরির বিষয়, ডাকাতির বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সি আর আবরার বলেন, আজকে সবাই নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত। আজকে জনগণের পক্ষে কেউ ঐক্যবদ্ধ হলে রাজনৈতিকভাবে তার জবাব না দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে। সরকার যদি উন্নয়ন করে থাকে তাহলে তাদের এত ভয় কেন?

সাবেক এমপি এ এস এম আকরাম বলেন, বর্তমানে সরকার যেভাবে চায় সেভাবেই আইন তৈরি হয়। তাই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনে সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে যত আইনই করা হোক সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। নির্দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, বর্তমান ইসি মেরুদহীন। সরকার যা চায় ইসি তাই করে। পাকিস্তান আমলের বেসিক ডেমোক্রেসির আদলে বর্তমানে কন্ট্রোলড ডেমোক্রেসি চালু রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী অভিযোগ করেন, সকল শর্ত পূরণ করার পরও নির্বাচন কমিশন থেকে তার দলকে নিবন্ধন দেয়া হয়নি। বিদ্যমান নিবন্ধন আইনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার হরণ করা হচ্ছে।

সুষ্ঠু ও কার্যকর নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য মূল প্রবন্ধে কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার। প্রস্তাবে বলা হয়, আইনে ‘না’ ভোটের বিধানের পুনঃপ্রবর্তন করতে হবে, মনোনয়নপত্র অনলাইনে দাখিলের বিধান সংযোজন করতে হবে, জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচনের ক্ষেত্রে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা ও আয়কর বিবরণী দাখিলের বিধান সংযোজন করতে হবে।

এছাড়া গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রতিটি দলের তৃণমূল পর্যায়ের সদস্যদের সম্মতির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রার্থীকে দিয়ে একটি প্যানেল তৈরি এবং এই প্যানেলের মধ্য থেকেই কেন্দ্র কর্তৃক মনোনয়ন চুড়ান্তকরণের বিধান সংযোজন করতে হবে, রাজনৈতিক দলের সকল স্তরের কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ ও নিয়মিত অপডেট করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে হবে।

লিখিত প্রবন্ধে আরও বলা হয়, রাজনৈতিক দলের সকল কমিটিতে ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব রাখার বিধানটি বিবেচনায় রেখে মনোনয়ন প্রদানের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট সংখ্যক নারীকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন প্রদানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে হবে, হলফনামার ছকে পরিবর্তন আনতে হবে, হলফনামার তথ্য নির্বাচন কমিশন কর্তৃক যাচাই বাচাই এর বিধান বাধ্যতামূলক করা এবং অসত্য ও বিভ্রান্তমূলক তথ্য প্রাদনকারীদের শাস্তির আওতায় আনার বিধানটির প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

পাশাপাশি নির্বাচনী ব্যয় হ্রাসের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রার্থীদের পোস্টার ছাপানো, হলফনামার তথ্য ভোটারদের মাঝে বিতরণ, প্রার্থী পরিচিতি সভা আয়োজন ইত্যাদি বিধান সংযোজনসহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রতি জোর দেয় সুজন। ২০১৭ সালে নির্বাচন কমিশনকে দেয়া এসব প্রস্তাবসহ নতুন আরো কিছু বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে সুজন।

প্রবন্ধে উল্লেখিত সুপারিশে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও কার্যকর করে গড়ে তুলতে কমিশনারদের নিয়োগে আইন প্রণয়ন করতে হবে, ভোটার তালিকা প্রণয়নে গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে, সীমানা পুনঃর্নিধারণে নির্বাচন কমিশনকে ভ‚মিকা পালন করতে হবে।

উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে আরপিও সংশোধনের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের পর মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত হয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে যাবে। সেখান থেকে সংসদে পাশ করার জন্য আইনটি উত্থাপন হবে। প্রস্তাবিত সংশোধনীর বাইরে সুজনের উত্থাপিত সুপারিশগুলো আরপিওতে সংযোজনের জন্য গোলটেবিল বৈঠকে আহন জানানো হয়।

পাশাপাশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আয়োজনের জন্য সুষ্ঠু আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা এবং রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে দ্রততার সঙ্গে সংলাপ আয়োজন এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি জাতীয় সনদ প্রণয়ন ও স্বাক্ষরের জন্য সরকারের প্রতি বিশিষ্টজনরা গোলটেবিল বৈঠকে আহন জানান।

বিডি২৪লাইভ/এএস/এসএস

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: