ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে শঙ্কা

প্রকাশিত: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০১:২২ পিএম

বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি, উদ্বেগ ও মতামত উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হয়। এ আইন পাসের মধ্য দিয়ে বিতর্কিত ৫৭ ধারার বিলপ্তি ঘটলেও হয়রানির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

এর আগে চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া অনুমোদন দেয় মন্ত্রসভা। তখন থেকে এই আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পক্ষ আপত্তি জানিয়ে আসছে। আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে সম্পাদক পরিষদ এই আইনের ৮টি (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৩) ধারা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়েছিল।

সম্পাদক পরিষদ মনে করে, এসব ধারা বাক-স্বাধীনতা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বাধা হতে পারে। এ ছাড়া ১০টি পশ্চিমা দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকেরা আইনমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এই আইনের ৪টি ধারা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। এছাড়া ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ৯টি ধারা পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছিল।

এদিকে সব মহলের আপত্তির মুখে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। এরপর সম্পাদক পরিষদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বিলটি নিয়ে দুই দফা বৈঠক করে সংসদীয় কমিটি। প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইনে বড় কোন পরিবর্তন আনা হয়নি। যে ধারাগুলো নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি ছিল, তার কয়েকটিতে কিছু জায়গায় ব্যাখ্যা স্পষ্ট করা, সাজার মেয়াদ কমানো এবং শব্দ ও ভাষাগত কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে।

সম্পাদক পরিষদসহ প্রায় সব মহলের কাছে সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল ৩২ ধারা নিয়ে। কিন্তু সামান্য সংশোধনী এনে ৩২ ধারা বহাল রাখা হয়েছে। বিলের ৩২ (১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি অফিশিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের আওতাভূক্ত অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওযার্ক বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করতে সহায়তা করেন তা হলে তিনি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

৩২ (২) ধরায় বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি উপধারা-১ এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন সংঘটন করেন, তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এ আইনে পুলিশকে পরোয়ানা বা অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আইনে রয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জন শৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা ব্লক বা অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এক্ষেত্রে পুলিশ পরোয়ানা বা অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেফতার করতে পারবে।

আপত্তি জানানো ধারাগুলো বহাল থাকায় হতাশ হয়েছে সাংবাদিকরা। তারা বলছেন, এ আইনের মাধ্যমে হয়রানির শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

তারা বলছেন, ৫৭ ধারা করার সময়ও বলা হয়েছিল, এ ধারা সাংবাদিকদের জন্য নয়। কিন্তু সাংবাদিকদরাই সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়েছে। এ ধারাগুলোও সাংবাদিকরাই সবচেয়ে বেশী হয়রানির শিকার হতে পারেন।

বিতর্কিত এ আইন পাস হওয়ায় গভীর হতাশা ব্যক্ত করেছে সম্পাদক পরিষদ। এর প্রতিবাদে আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি।

১৮ জন সম্পাদক বিবৃতি দিয়ে এই মানববন্ধনে যোগ দিতে সব সাংবাদিক, গণমাধ্যম সংগঠন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের প্রতি অনুরোধ জানায়। বিবৃতিদাতা সম্পাদকেরা হলেন, নিউজ টুডের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম, সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান, নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর, কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন, ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন, দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক, করতোয়া সম্পাদক মোজাম্মেল হক, ইনডিপেনডেন্ট সম্পাদক এম শামসুর রহমান, যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম, বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান, সমকালের সহযোগী সম্পাদক সবুজ ইউনূস ও ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের যুগ্ম সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ।

আর এই আইনের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়া তিন গণমাধ্যম প্রতিনিধি যৌথ বক্তব্যে বলেছেন, সংসদে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলে গণমাধ্যমকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়নি। বরং পুলিশকে অবাধে ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দিয়ে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করার পথ সুগম করা হয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বিডি২৪লাইভকে বলেন, এ আইনে সরকার নতুন বোতলে পুরাতন সেই একই জিনিস আনলো। এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের কতগুলো অধিকার রয়েছে। বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। প্রয়োজনীয় অধিকার যখন সংকুচিত হয় তখন সরকার আর গণতান্ত্রিক চরিত্রে থাকেনা। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

এ বিষয়ে সাভারে একটি অনুষ্ঠানে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সাংবাদিকদের বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গণমাধ্যম বা কারও স্বাধীন মতপ্রকাশ হরণ করার জন্য নয়। এই আইন ডিজিটাল অপরাধ দমনের জন্য যা সকল নাগরিকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।

বিডি২৪লাইভ/এএইচ

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: