কালো রসুন এর প্রবর্তন নোবিপ্রবি শিক্ষকের সাফল্য

প্রকাশিত: ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ০৩:৫৬ পিএম

হাজার বছর ধরে পৃথিবীর অনেক দেশে রসুন একটি খাবার ও মশলা হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। চার হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ঐতিহ্যবাহী ঔষধ হিসেবে রসুন পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এটি ‘রাশিয়ান পেনিসিলিন’ নামে পরিচিত ছিল। বিখ্যাত মাইক্রোবায়োলজিস্ট লুই পাস্তুরও রসুনের ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী বৈশিষ্ট প্রদর্শন করেছিলেন। 

স্বাভাবিক রসুনের আরেকটি ধরণ কালো রসুন (ব্লাক গারলিক) একটি প্রক্রিয়াজাত রসুনপণ্য। এটির রং কালো, কম তীব্র গন্ধযুক্ত এবং মিষ্টি স্বাদযুক্ত ফলে এটি কোনো ফুড এডিটিউস যোগ করা ছাড়াই সহজে খাওয়া যায়। জাপানোর হিরোশাকি ইউনিভারসিটি অব হেলথ সাইন্স এর সাবেক বিখ্যাত প্রফেসর ড. জিন ইচি সাসাকি এটির নাম দেন ‘ ভেজি ফ্রুটস’ যার অর্থ উদ্ভিজ্জ এবং ফলের ২টি মুখ। ১৯৯৯ সালে কালো রসুন প্রথম জাপানে তৈরি হয় এবং এটি জাপানের ‘মী প্রিফেকচার’ এর নাগরিক কামিমুরা তৈরি করেন। 

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ড. সুবোধ কুমার সরকার জাপানের হিরোশাকি ইউনিভারসিটি অব হেলথ সায়েন্স এর সাবেক বিখ্যাত প্রফেসর ড. জিন ইচি সাসাকির সহযোগিতায় বাংলাদেশে প্রথম তিন ধরনের কালো রসুন, নোবিপ্রবি-বিজি-১ (ডিএল-বিজি), নোবিপ্রবি-বিজি-২(ডিএস-বিজি) ও নোবিপ্রবি-বিজি-৩ (সিএল-বিজি) তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। 

এ গবেষণায় তিন ধরনের তৈরিকৃত কালো রসুনের সঙ্গে তিন ধরনের সাধারণ রসুনের তুলনা করা হয় এবং দেখা যায় যে, তিন ধরনের কালো রসুনের মধ্যে উচ্চ মাত্রায় ফ্লেভানয়েড, অ্যালকালয়েড, স্যাপোনিন, ট্যানিন, কারডিয়্যাক গ্লাইকোসাইড ও রিডিউসিং সুগার উপস্থিতি আছে এবং পরীক্ষার ফলাফলে আরো দেখা যায় যে, নোবিপ্রবি-বিজি-১ এবং নোবিপ্রবি-বিজি-২ এর নির্যাস নোবিপ্রবি-বিজি-৩ এর নির্যাস এর চেয়ে গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে শক্তিশালী কার্যকারীতা প্রদর্শন করে। 

এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও ফাইটোকেমিক্যাল স্কিনিং পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় যে, জাপানের তৈরি কালো রসুনের মত নোবিপ্রবি-বিজি-১ ও নোবিপ্রবি-বিজি-২ কালো রসুনে ও শক্তিশালী জৈব যৌগিক যৌগ উপস্থিত রয়েছে যা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া বিশেষ করে গ্রাম পজিটিভ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ঔষুধি সম্পূরক হিসেবে উপকারী হতে পারে। 

পরীক্ষার ফলাফলটি আরো নির্দেশ করে যে, নোবিপ্রবি-বিজি-১ এবং নোবিপ্রবি-বিজি-২ কালো রসুন নোবিপ্রবি-বিজি-৩ (সিএল-বিজি) চীনা বড় জাতের এবং জাপানি বড় জাতের (জেএল-বিজি) এর চেয়ে প্রকৃিততে উচ্চমানের।

ড. সুবোধ কুমার সরকার এই গবেষণা কাজটি পরিচালনা করেন জাপানোর হিরোশাকি ইউনিভারসিটি অব হেলথ-সাইন্স এর সাবেক প্রফেসর ড. জিন ইচি সাসাকি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রো বায়োলজি বিভাগের প্রফেসর ড. চৌধুরী রফিকুল এহসানের সহায়তায় ফিলিপাইন এর মেরিয়ানা মারকোস ইউনিভারসিটির প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. শেরলি কাস্তেনেদা আরাপিস, টোকিও ইন্সিটিটিউট অব টেকনোলজি, জাপান এর ইন্সিটিটিউট প্রফেসর ও বায়োসাইন্স এন্ড বায়োটেকনোলজি ফ্যাকাল্টির সাবেক প্রফেসর ড. হিরোস সিজেহিসা এবং সিজুওকা ইন্সিটিটিউট অব টেকনোলজির ম্যাটোরিয়াল এন্ড লাইফ সাইন্স এর সহযোগী অধ্যাপক ড. তাথসুরো মিয়াজি এই প্রকল্পে আরও একসাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশে কালো রসুনের উপর কাজের জন্য ড. সুবোধ কুমার সরকার ব্লাক গারলিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন, ২০১৮ এবং আওমরি ব্লাক গারলিক এসোসিয়েশন এর প্রসিডেন্ট মি: সিনিচি কাসিওজাকি এর নিকট থেকে গত ৬ই সেপ্টেম্ভর ২০১৮ তারিখে জাপানের হাচিনোহিতে অনুষ্ঠিত ৩য় আন্তর্জাতিক ব্লাক গারলিক সম্মেলন-এ ‘ব্লাক গারলিক অ্যামবাসিডর’ হিসেবে উপাধি পান।

এই উপাধিটি শুধুমাত্র জাপানের হিরোশাকি ইউনিভারসিটির সাবেক প্রফেসর, প্রফেসর  ড. জিন ইচি সাসাকি ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. এম অহিদুজ্জামান এর সাহায্য, উৎসাহ ও সার্বিক সহযোগিতার ফলেই সম্ভব হয়েছে বলেই এই গবেষক মনে করেন। এই তিন ধরনের কালো রসুন তৈরির গবেষণার ফলাফল ২টি আন্তর্জাতিক সম্মেলন, একটি কম্বোডিয়ায় ফুড সেফটি ও ফুড সিকিউরিটির উপর ৪র্থ এএফএসএ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গত ১১ ই আগষ্ঠ ২০১৮ এবং একটি জাপানের হাচিনোহিতে ৩য় আন্তর্জাতিক ব্লাক গারলিক সম্মেলন এ গত ৬ই সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে উপস্থাপন করা হয়।

এই ব্লাক গারলিক প্রকল্পের গবেষক মনে করেন সরকারি আর্থিক সুবিধা ও সার্বিক সহায়তা পেলে বেশি পরিমানে এই নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্লাক গারলিক তৈরি করা সম্ভব হবে এবং মানবস্বাস্থের জন্য এই ঔষধি সম্পূরকটি ব্যবহারের জন্য দেশ জুড়ে বিস্তৃত করা সম্ভব হবে। এছাড়াও এই ব্লাক গারলিকগুলি অন্যান্য দেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে ফলে  আমাদের দেশ অর্থনৈতিক ভাবে উপকৃত হবে। 

প্রসঙ্গত, কালো রসুনের অনেক ঔষুধি গুণাগুণ আছে যা এটি-অক্সিডেন্ট একটিভিটি, এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল একটিভিটি, এন্টি-ডায়াবেটিক একটিভিটি, এন্টি-টিউমার, এন্টি-ক্যানসার একটিভিটি প্রকাশ করে এবং রক্তে উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি করে।

সম্প্রতি জাপান, কোরিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইনসহ অন্যান্য দেশে কালো রসুনের উৎপাদন শুরু হয়েছে। কালো রসুনের বাজার মূল্য শুধু কোরিয়া এবং অ্যামেরিকাতে আনুমানিক ৯৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। জাপানে, কোরিয়া, চীন, অষ্ট্রেলিয়া, ইউকে, ফিলিপাইন ও অন্যান্য দেশের সংশ্লিষ্টতায় কালো রসুন তৈরির কোম্পানির প্রতিষ্ঠার যাত্রা শুরু হয়েছে। 

কালো রসুনের ঔষুধি ও অর্থনৈতিক মূল্যের কারণে যদিও জাপান, কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউকে, অষ্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন এবং অন্যান্য দেশ এটি তৈরি করছে কিন্তু এ বিষয়ে প্রচার ও গবেষণা উভয়ের স্বল্পতার কারনে এটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে খ্যাতি অর্জনসহ খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় নাই। 
 
বিডি২৪লাইভ/এমকে

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: