অপারেশনে কিডনি উধাও, মীমাংসার জন্য টাকা দিতে চাচ্ছেন চিকিৎসক!

প্রকাশিত: ২৯ অক্টোবর ২০১৮, ০৫:৪৭ পিএম

বেশ কিছু দিন আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নির্মাতা রফিক শিকদারের মা রওশন আরা বেগম এ ঘটনায় অভিযুক্ত চিকিৎসক ওই সময় একটি কিডনি অপারেশন করাতে গিয়ে দুইটি কিডনি হারান। বর্তমানে তিনি কোমান আছেন।

শুরুতে কর্তব্যরত ডাক্তার ঘটনা অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে প্রচার হওয়ায় এবং রোগীর ছেলের পক্ষ থেকে আইনি নোটিশ পাঠানোর পর তাড়াহুড়ো করে ক্ষতিপূরণ দিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপনের চুক্তিনামা করেছিলেন। স্ট্যাম্পে করা ওই চুক্তিনামায় চিকিৎসক কর্তৃক অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কিডনি হারানোর কারণেই ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও অভিযুক্তের দাবি, তিনি রোগীকে ছোটবোন মনে করেই ওই টাকা দিতে সম্মত হয়েছিলেন।

কিডনি জটিলতার কারণে গেল ৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বিএসএমএমইউ হাসপাতালে চলচ্চিত্র পরিচালক রফিক সিকদারের মা রওশন আরা’র অস্ত্রোপচার করেন হাসপাতালের কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিভাগের প্রধান হাবিবুর রহমান দুলাল। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পর রোগীর দেহে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় অন্য চিকিৎসককে দেখিয়ে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রফিক শিকদার এটা নিশ্চিত হন যে, অস্ত্রোপচারে তার মায়ের বাম কিডনিটি ফেলে দেয়ার কথা থাকলেও অস্ত্রোপচারের পর থেকে ডান কিডনিটিও অনুপস্থিত।

বিষয়টি নিয়ে তখন হাবিবুর রহমান দুলালের সাথে কয়েক ধফা কথা বলা হলেও তিনি দাবি করেন, রওশন আরা’র একটি কিডনিই ফেলে দেয়া হয়েছে এবং তার অপর কিডনিটি এখনও দেহেই আছে। তবে অপারেশনের পর নন ভিজ্যুয়ালাইজ (দেখা না যাওয়া) হওয়ায় মনে হচ্ছে দেহে কিডনিটি নেই। তবে ডান কিডনি তার দেহেই রয়েছে। এ ঘটনায় হাসপাতালের পক্ষ থেকে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি ও ছয় সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ডও গঠন করা হয়।

তবে হাবিবুর রহমান ভুল বোঝাচ্ছেন বলে দাবি করে যাচ্ছিলেন রফিক সিকদার। হাবিবুর রহমানের দেয়া যুক্তির সঙ্গে এক মত ছিলেন না অন্য চিকিৎসকরাও। পরবর্তীতে রফিক শিকদার বিষয়টি নিয়ে আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ২৯ সেপ্টেম্বর রফিক সিকদার আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মাধ্যমে অভিযুক্ত চিকিৎসক হাবিবুর রহমানকে একটি আইনি নোটিশ পাঠান। ওই নোটিশে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিষয়টির সুরাহা করার কথা উল্লেখ ছিল।

এ বিষয়ে রফিক সিকদার বিডি২৪লাইভকে বলেন, হাবিবুর রহমান আইনি নোটিশ পাওয়ার পরপরই পরিচালক সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। তিনি নিজের দোষ স্বীকার করেন এবং আমার মায়ের কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের সব খরচ বহনসহ যিনি কিডনি দেবেন তাকে আট লাখ টাকা দিতে সম্মত হন।

বিষয়টি নিয়ে অক্টোবরের ১ তারিখ ১০০ টাকার তিনটি স্ট্যাম্পে একটি চুক্তিনামা হয়। চুক্তিনামায় উল্লেখ থাকা দুই পক্ষের মধ্যে রোগীর হয়ে সেখানে সই করেন রফিক সিকদার এবং অপরপক্ষ হাবিবুর রহমান দুলাল।

ওই চুক্তিনামায় উল্লেখ করা হয়, উভয়পক্ষের সম্মতিতে প্রথমপক্ষ চিত্রপরিচালক রফিক সিকদার এর মাতা রওশন আরা বেগম, স্বামী- মো. ওয়াজেদ আলী সিকদার, ঠিকানা. গ্রাম-আহাম্মদপুর, থানা- আমিনপুর, জেলা-পাবনা এর চিকিৎসা ক্ষেত্রে তাহার বাম কিডনি অপারেশন করার পর চিকিৎসক কর্তৃক অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে উভয় কিডনি হারানো রোগীকে (রওশন আরা বেগম) নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনের জন্য উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে নিম্নবর্ণিত শর্ত সাপেক্ষে এই চুক্তিপত্র সম্পাদিত হইল।

সেখানে দুটি শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়। প্রথম শর্তে বলা হয়, চিত্রপরিচালক রফিক সিকদারের খালা মোসাম্মৎ জায়েদা বেগম এর স্বেচ্ছায় বোনের জন্য কিডনি প্রদানের সম্মতিক্রমে প্রথমপক্ষ রফিক সিকদার এর মাতার পরবর্তী চিকিৎসা প্রদান (কিডনি প্রতিস্থাপন) বাবদ যাবতীয় খরচাদি দ্বিতীয়পক্ষ বহন করিতে বাধ্য থাকিবে। এখানে উল্লেখ থাকে থাকে যে, অত্র চুক্তিপত্রের সময়কাল হতে রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপনসহ এর পরবর্তী সকল চিকিৎসার ব্যয়ভার দ্বিতীয়পক্ষ বহন করিতে বাধ্য থাকিবে। এখানে কোনোভাবে দ্বিতীয়পক্ষ ওজর আপত্তি করিতে পারিবেন না। এখানে আরও উল্লেখ থাকে যে, কিডনি প্রদানকারি জায়েদা বেগম, (রোগীর ছোটবোন)’কে নগদ ৮ লাখ টাকা প্রদানসহ অপারেশন পরবর্তীতে তাহার সম্পূর্ণরূপে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় খরচাদি দ্বিতীয়পক্ষ বহন করিবে।

দ্বিতীয় শর্তে বলা হয়, রোগীর সন্তান প্রথমপক্ষ চিত্রপরিচালক রফিক সিকদার দ্বিতীয়পক্ষ প্রফেসর হাবিবুর রহমান দুলালকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সহযোগিতা প্রদান করিবেন।

রফিক সিকদার জানান, এই শর্তের পর হাবিবুর রহমান দুলাল পরিচালক সমিতির কাছে ৮ লাখ টাকার একটি চেক প্রদান করেন। তবে ওই চেক ক্যাশ করতে নিষেধ করে দেন এবং বলেন, তিনি বলার পরই যেন টাকাটা ক্যাশ করা হয়। ওই চুক্তিনামার পর থেকেই হাবিবুর রহমান দুলাল বিভিন্ন টালবাহানা শুরু করেন। তিনি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। বিষয়টি নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, অস্ত্রোপচারের জন্য দরকারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সিরিয়াল পাওয়া যাচ্ছে না।

রফিক সিকদার আরও বলেন, যখন হাবিবুর রহমান আমাকে সিরিয়াল না পাওয়ার দোহাই দিচ্ছিলেন তখন আমি তাকে বলি, দরকার হয় আপনি বেসরকারি হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করেন, যা খরচ হয় সব আমিই দেব। কিন্তু তিনি তাতেও রাজি হননি। এদিকে আমার মায়ের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। গত বুধবার দিবাগত রাত থেকে তার কোনো হুঁশ নেই। তিনি ক্লিনিক্যালি ডেড।

বিষয়টি নিয়ে অভিযুক্ত হাবিবর রহমান দুলাল বলেন, অস্ত্রোপচারের পর আমি মনে করেছিলাম তার কিডনি দেহেই রয়েছে, কিন্তু নন-ফাংশনাল হয়ে আছে। কিন্তু সপ্তাহখানেক পর নিশ্চিত হই তার দেহে কিডনি অনুপস্থিত। তবে অস্ত্রোপচারের আগের রিপোর্টে তার দেহে দুটি কিডনিই রয়েছে বলে দেখা গেছে।

তবে দুটি কিডনিই অনুপস্থিত এটি জানার পর প্রতিস্থাপনে দেরি কেন? এর ব্যাখ্যায় হাবিবুর রহমান বলেন, রাতারাতি কারও কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। ডোনার পরীক্ষাসহ আমরা সব ধরনের পরীক্ষা সম্পন্ন করেছিলাম। সবকিছু শেষে কিডনি প্রতিস্থাপনে তিন সপ্তাহ সময় গণনা শুরু হয়েছিল। সেই সময়ের দুইদিন যেতেই রোগী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এখন তিনি কোমায় আছেন।

কিডনি উধাও হওয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হাবিবুর রহমান দুলাল বলেন, জন্মগতভাবেই তার দুটি কিডনি একসঙ্গে ছিল। সেটা হাসপাতালে ভর্তির পূর্বে রফিক সিকদারের করানো একটি পরীক্ষায় ধরা পড়লেও সেটি আমরা দেখিনি। সেটা আগে না জানলে অস্ত্রোপচারের সময় বোঝা যায় না।

তবে নিজের ভুল না থাকলেও কেন টাকা দিতে চেয়ে চুক্তিনামা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রফিক সিকদারের খালার সন্তানরা তার দেখাশোনা করেন না। আর তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় আমি নিজে থেকেই টাকা দিতে সম্মত হয়েছি। আমি তাকে নিজের ছোট বোনের মতো ভেবেছি।

এ বিষয়ে বিএসএমএমইউ’র উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান হারুনুর রশিদ দেশের বাইরে আছেন। তিনি দেশে ফিরে প্রতিবেদন জমা দিলে সেখানে কোনো গাফিলতি পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। দায় স্বীকার করে হাবিবুর রহমান কোনো চুক্তিনামা করেছেন বলে আমার জানা নেই। তবে কেবলমাত্র তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

রোগীর সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, রওশন আরা’র একটি স্ট্রোক হয়েছে বলে জেনেছি। তার চিকিৎসায় সকালে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তিনি আইসিইউ’তে আছেন।

তবে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার আগেই প্রতিবেদনের ফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন রফিক সিকদার। তিনি বলেন, মানবদেহের অর্গান প্রতিস্থাপন সংস্থার প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন তদন্ত কমিটির প্রধান হারুনুর রশিদ। ওই সংস্থারই সেক্রেটারি হিসেবে আছেন হাবিবুর রহমান দুলাল। সুতরাং এ তদন্ত প্রতিবেদন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা হতে পারে বলে আমি মনে করছি।

রোববার (২৯ অক্টোবর) এক প্রেস কনফারেন্স রফিক সিকদার তার মায়ের চিকিৎসা ও অভিযুক্ত হাবিবর রহমান দুলালের শাস্তি চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করেন।


বিডি২৪লাইভ/এইচকে

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: