এক বালতি পানি, আসিয়া বিবির ফাঁসি!

প্রকাশিত: ৩১ অক্টোবর ২০১৮, ০৫:৪৭ পিএম

পাকিস্তানের আসিয়া বিবি নামে যে খ্রিস্টান মহিলাকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছিল, পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করে দিয়েছে। এই মামলাকে ঘিরে পাকিস্তান কার্যত বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।

ইসলামের নবী মোহাম্মদকে অবমাননার অভিযোগে আসিয়া বিবিকে ২০১০ সালে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়। প্রতিবেশিদের সঙ্গে ঝগড়ার সময় তিনি নবীর অবমাননা করেন বলে অভিযোগ করা হয়।

আসিয়া বিবি সব সময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করে এসেছেন। কিন্তু গত আট বছর ধরে তাকে কারাগারে নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাখা হয়েছে। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের আজকের রায়কে যুগান্তকারী বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এই রায়ের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের কট্টরপন্থীরা এরই মধ্যে তীব্র বিক্ষোভ শুরু করেছে। পাকিস্তানের কট্টরপন্থী ইসলামী গোষ্ঠীগুলো ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননার অভিযোগের জন্য কঠোর সাজার পক্ষে।

রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য পাকিস্তানের করাচী, লাহোর এবং পেশাওয়ার শহরে কট্টরপন্থীরা জড়ো হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি সাকিব নিসার্ম আসিয়া বিবির মামলার রায় ঘোষণা করে তাকে মুক্তির নির্দেশ দেন। আসিয়া বিবি লাহোরের কাছে শেখুপুরা কারাগারে বন্দী আছেন।

বিচারকরা তাদের রায়ে বলেন, ‘বাদী পক্ষ তাদের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছেন।’

তারা আরও বলেছেন, ঠুনকো প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে এই মামলা করা হয়েছে। এতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। আর আসিয়া বিবিকে যখন উন্মত্ত জনতা হত্যার হুমকি দিচ্ছিল, সেই অবস্থায় তার কাছ থেকে কথিত ধর্ম অবমাননার স্বীকৃতি আদায় করা হয়।

বিচারকরা তাদের রায়টিতে কোরান এবং ইসলামের ইতিহাস থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়েছেন। রায়টি শেষ হয়েছে নবী মোহাম্মদের একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে, যাতে অমুসলিমদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।

আদালতে যখন রায় ঘোষণা করা হয়, তখন আসিয়া বিবি সেখানে ছিলেন না। কারাগারে যখন তার কাছে এই খবর এসে পৌঁছায়, তিনি তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

টেলিফোনে তিনি এএফপি বার্তা সংস্থাকে বলেন, ‘যা শুনছি তা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। এখন কি আমি বাইরে যেতে পারবো? ওরা কি আমাকে বাইরে যেতে দেবে?’

আসিয়া বিবির বিরুদ্ধে অভিযোগ কী?

আসিয়া বিবির পুরো নাম আসিয়া নরিন। ২০০৯ সালে তিনি নিজের গ্রামের প্রতিবেশী কয়েকজন মহিলার সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়েছিলেন। সেখান থেকে এই মামলার শুরু।

আসিয়া এবং তার প্রতিবেশিরা গাছ থেকে ফল পাড়ছিলেন। তখন এক বালতি পানি নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়। আসিয়া একটি কাপে করে ঐ বালতির পানি খেয়েছিলেন। তখন অন্য মহিলারা বলেন, যেহেতু আসিয়া অমুসলিম, তার স্পর্শ করা ঐ পানি তারা খেতে পারবেন না, কারণ ঐ পানি এখন নোংরা হয়ে গেছে।

মামলায় বাদীপক্ষ অভিযোগ করেছিল, এ নিয়ে ঝগড়া শুরু হওয়ার পর গ্রামের মহিলারা আসিয়াকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হতে বলেন। কিন্তু তখন আসিয়া নবী মুহাম্মদ সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করেন।

আসিয়ার বিরুদ্ধে যারা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ করেছিল, তারা পরে আসিয়াকে তার বাড়িতে গিয়ে মারধোর করে। তারা দাবি করছে, এই মারধোরের সময় আসিয়া নাকি ইসলাম অবমাননার দোষ স্বীকার করেন। এরপর আসিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে পুলিশ তদন্ত শুরু করে।

আসিয়া বিবির মামলা নিয়ে পাকিস্তান এতটাই বিভক্ত হয়ে পড়ে যে সেখানে এই বিতর্কে পাঞ্জাব রাজ্যের গভর্ণর সালমান তাসিরকেও প্রাণ দিতে হয়। তিনি ব্লাসফেমি আইনের বিরুদ্ধে কথা বলায় তাকে গুলি করে হত্যা করে তারই দেহরক্ষী।

শুধু তাই নয়, হত্যাকারী দেহরক্ষী মুমতাজ কাদিরকে যদিও এই হত্যার দায়ে ফাঁসি দেয়া হয়, তাকে পাকিস্তানের কট্টরপন্থী ইসলামী দলগুলো তাদের নায়কে পরিণত করে। ইসলামাবাদের উপকন্ঠে মুমতাজ কাদরির সমাধি সৌধ তাদের জন্য রীতিমত তীর্থস্থানে পরিণত হয়।

এমনকি মুমতাজ কাদরির সমর্থকরা একটি রাজনৈতিক দল পর্যন্ত গঠন করে। এরা ব্লাসফেমি আইন রদ করার বিপক্ষে। গত নির্বাচনে এই দল প্রায় বিশ লাখ ভোট পেয়েছে।

ইসলাম হচ্ছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রধর্ম। সেখানে ব্লাসফেমি আইনে ইসলামের অবমাননার সর্বোচ্চ সাজা হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু এই আইন অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত শত্রুতা চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন অনেকে। তারা এই আইন বাতিলের পক্ষে।

পাকিস্তানে এই আইনে প্রথম মৃত্যুদণ্ডের সাজা পাওয়া মহিলা হচ্ছেন আসিয়া।

পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনে সবচেয়ে বেশি সাজা পেয়েছেন সংখ্যালঘু আহমদীয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। বহু খ্রীস্টানও এই আইনে সাজা ভোগ করেছেন। যদিও পাকিস্তানের জনসংখ্যার মাত্র এক দশমিক ছয় শতাংশ হচ্ছেন খ্রীস্টান।

ব্লাসফেমি আইনে পাকিস্তানে আজ পর্যন্ত কারও ফাঁসি হয়নি। কিন্তু ব্লাসফেমির অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, তাদের অনেককে খুন করা হয়েছে।

আসিয়া বিবির জন্ম ১৯৭১ সালে। তিনি চার সন্তানের মা। তাকে ব্লাসফেমি আইনে মৃত্যুদন্ড দেয়ার ঘটনার আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হয়।

সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পর এখন আসিয়া বিবিকে মুক্তি দেয়া হলে তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানে সহিংস বিক্ষোভের আশংকা করা হচ্ছে। তার পরিবারও নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত।

বেশ কয়েকটি দেশ আসিয়া বিবিকে আশ্রয় দিতে চেয়েছে। মুক্তির পর আসিয়া বিবি এবং তার পরিবার দেশত্যাগ করতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।

বিডি২৪লাইভ/এইচকে

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: