আত্মসম্মান বাঁচাতে রাস্তায় থাকেন অসুস্থ মকবুল!
দুপুর বেলা একটা গাছের নিচে বসে প্যাকেট থেকে কিছু খাবার বের করে খাচ্ছে ৭০-৮০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ। চোখে মুখে কষ্টের ছাপ আর ক্ষুধা। এক হাত পুরো অবস মনে হচ্ছে। আরেক হাত দিয়ে অনেক কষ্ট করে তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে যেন অনেক দিন কিছু খায় নি। পাশে রাখা একটা লাঠি আর দুটো ব্যাগ যার মধ্যে রয়েছে তার কিছু কাপড়, একটা বালিশ আর একটা কম্বল। খাওয়া শেষ করে উঠতে পারছে না, তবুও চেষ্টা করছে উঠে দাঁড়ানোর।
সহযোগীতা করে উঠিয়ে দেওয়ার পর কথা বলার ছলে তাকে আবার বসতে সাহায্য করলাম। জানতে চাইলাম শরীর অসুস্থ নাকি! এমন প্রশ্নে চোখে পানি এনে মকবুল নামের এই বৃদ্ধ বলেন, আমার শরীরের একটা সাইড পুরা অবশ, প্যারালাইজড হয়ে গেছি। লড়াচড়া (নড়াচড়া) করতাম পারি না।
উনাকে এক কাপ চা খেতে বললাম উনিও রাজি হলেন। চা খেতে খেতে তিনি বললেন নিজের জীবনের কষ্টের কিছু কথা। মকবুল হোসেন নামের এই বৃদ্ধের দেশের বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচং এলাকায়। সেখানে তার বৃদ্ধ বয়সী মা রয়েছেন শুধু। মায়ের জন্য তার মন খুব কাঁদে তাই মন চাইলেও যেতে পারেন না মাকে দেখতে।
তবে যখন কিছু টাকা যোগাড় করতে পারেন তখন হয়ত মাকে এক নজর দেখতে যান আর অল্প কয়েকটা টাকা মায়ের হাতে দিয়ে আসেন তিনি। দুই বছরের মধ্যে মাকে আর দেখতে যাওয়া হয় নি তার। বেশ কয়েক বছর ধরে তার শরীরের একপাশ প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে। কিছুই করতে পারেন না। বেশিরভাগ সময় কোন পার্কে বসে থাকেন। খুব বেশি নড়াচড়া করতে পারেন না। কারো কাছ থেকে চেয়ে ২০-৩০ টাকা পেলে সেটা দিয়ে কিছু কিনে খান এভাবেই চলে তার প্রতিটা দিন।
৫২ বছর আগে ঢাকায় আসেন তিনি। মিষ্টান্ন ভান্ডারে কাজ করতেন। খুব ভালো মিষ্টি প্রস্তুত করতেন তিনি। শুকনো ও ভেজা দুই ধরনের মিষ্টিই খুব ভালো করে প্রস্তুত করতে পারতেন। ঢাকার মালিবাগ, গেন্ডারিয়া, কমলাপুর আরো অনেক দোকানে কাজ করেছেন। সেখানে কাজ করেই সংসার চালাতেন তিনি। পরিবারে তার স্ত্রী ও এক ছেলে এক মেয়ে।
মেয়েকে বিএ পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের জামাই টাঙ্গাইলে কন্ট্রাক্টরের কাজ করে। আর ছেলেটা ম্যাট্রিক পাশ করার পর আর পড়তে পারেনি টাকার অভাবে। তারপরও সব মিলিয়ে ভালোই ছিলো সংসার। দেশের বাড়িতে তার কিনা দেড় কানি জমি আছে কিন্তু সেটা তার চাচাতো বোনেরা দখল করে নিয়েছেন। তাদেরকে থাকতে দেন না। কেন জানতে চাইলে মকবুল বলেন। তারা লেখাপড়া কইরা শিক্ষিত হইয়া গেছে, তাদের সাথে কে পারে! আমাদের জায়গা দেয় না।
তিনি জানান, আমি যখন কাজ করতাম তখন সবাই কত আসতো আমার কাছে। আমার চাচাতো ভাই সেনাবাহিনীর কর্ণেল ছিলো। তখন আমারো খোজ নিত, বাড়িতে আসতো। এখন আর আসে না। আমি যখন অসুস্থ হয়ে যাই এরপর থেকে আমার কষ্ট শুরু হতে থাকে।
আমার শরীর প্যারালাইজড হওয়ার পর কোন কাজ করতে পারি না। বছর খানেক আগে আরো অনেক অসুস্থ হয়ে গেছিলাম। আমার মুখ বাঁকা হয়ে গেছিলো। আমি একটা পার্কে বসে ছিলাম। তখন আমার পাশে কেউ আসে নি। আমি গামছা বেঁধে অনেক কষ্টে হাসপাতালে যেতে লাগলাম। কিন্তু কোন বাস আমাকে গাড়িতে তুলে না। আমাকে দেখে সবাই তাড়িয়ে দিলো। পরে অনেক কষ্টে হাসপাতালে গেলেও কোন ডাক্তার আমাকে দেখে নি।
আমার মেয়ের জামাইয়ের পরিচিত একজন লোক আমাকে মিরপুর একটা হাসপাতালে যেতে বলল আর কিছু টাকাও দিলো। আমি যাওয়ার পর ডাক্তার আমারে মুখের মধ্যে কি জানি করলো! আমার অনেক কষ্ট হইছে, হাত পা আটকে রেখে কেমনে কি জানি করলো। ঐ ডাক্তার আমার থেকে কোন টাকা নেয় নি। আর আমাকে কিছু টাকা দিয়ে দিলো আর কিছু কাপড় দিছিলো। আমি আমার ব্যাগে কইরা নিয়া চইলা আসি। মহাখালি আসছিলাম। এখানে আমাকে দেখে একজন লোক চিনিনা, আমাকে টাকা দিবে বলে রাস্তার একপাশের দোকানে আসতে বলে। এরপর আমি আসলে এই ফাকে আমার ব্যাগ গুলা নিয়ে পালায়া যায়।
স্ত্রী এখন মেয়ের সাথে মেয়ের বাড়িতে থাকে আর ছেলেটা মেয়ের জামাইয়ের সাথে কাজ করে। কিন্তু মকবুলের সেখানে থাকতে ভালো লাগে না। বসে বসে খাওয়া নিজের আত্মসম্মানে লাগে বলে মনে করেন তিনি।
মেয়ের জামাই মাঝে মধ্যে টাকা দিত। কিন্তু তিনি সেখানে না থেকে ঢাকায় হাইকোর্টের পিছনে এক বট গাছের নিচে থাকেন। ব্যাগে রাখা কম্বল আর বালিশটা দিয়েই চালিয়ে নেন কোনভাবে। আর অনেক সময় অনেকে খাবার বিতরণ করলে তার ভাগ কিছুটা জুটে সেটা দিয়েই দিন পার করে দেন। অনেক সময় না খেয়েও দিন পার করে দেন। আর একমাত্র সম্বল কম্বলটা জুটেছিলো অনেক কষ্টে। কিছু শিক্ষার্থী দুস্থদের মধ্যে শীতের কাপড় বিলি করছিলো। সেখান থেকে পাওয়া এই কম্বলই এখন তার সম্বল।
হাইকোর্টের পাশের মসজিদের হুজুর তাকে মাঝেমধ্যে সাহায্য করেন। টাকা দেন মাঝেমাঝে খাবারও দেন। এমনটাই জানান তিনি।
বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থার কারণে কারো কাছে গেলেও কেউ দেখতে পারে না তাকে, সাহায্য তো দূরের কথা। তবুও নিজের আত্মসম্মানের কথা ভেবে ভিক্ষা করেন না তিনি। যখন খেতে না পারেন তখন খাওয়ার কথা বলে কিছু টাকা চেয়ে নেন। পেলে কিছু খান না হলে না খেয়েই দিন পার করে দেন মকবুল হোসেন।
বিডি২৪লাইভ/আইএন/এসএস
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]
পাঠকের মন্তব্য: