ওরা গরিব বলেই পাশে নেই কেউ!

প্রকাশিত: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:১৮ এএম

রাজীব আহাম্মদ: বিদেশের মাটিতে ঘাম ঝরিয়ে আয় করেন বাংলাদেশের মেয়েরা। তাদের পাঠানো টাকায় দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। তাদের শ্রমে বাড়ে দেশের রিজার্ভ। আর তারাই যখন বিদেশের মাটিতে প্রতিনিয়ত লাঞ্ছনা ও পাশবিক নিপীড়নের শিকার হন, তখন তাদের পাশে দাঁড়ায় না কেউ। নির্যাতনের শিকার হলে দেশে ফিরিয়ে এনে দায়িত্ব শেষ করছে দূতাবাস ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। অথচ আজ পর্যন্ত এ ঘটনার একটিরও বিচার হয়নি; সাজা পায়নি কোনো দোষী। এ কারণেই বিদেশের মাটিতে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের মেয়েদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন বেড়েই চলেছে।

সৌদি আরবে গৃহকর্মে মেয়ে পাঠাতে পারলেই কর্মীপ্রতি দুই হাজার ডলার পায় রিক্রুটিং এজেন্সি। টাকা উপার্জনের এমন সহজ রাস্তা খোলা থাকায়, অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরও বিদেশে পাঠাচ্ছে এজেন্সি ও দালালরা। পাসপোর্ট দেওয়ার সময় পুলিশের যাচাই-বাছাই করার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। 

বিদেশ যাওয়ার আগে কর্মীর বিস্তারিত তথ্য যাচাইয়ের দায়িত্ব প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি)। তবে দালালের বানানো ভুয়া পাসপোর্ট ও মেডিকেল সার্টিফিকেটে বিদেশ চলে যাচ্ছে কর্মী। বিমানবন্দরেও নেই নজরদারি। বিএমইটির মহাপরিচালক সেলিম রেজা সমকালকে বলেছেন, অনিয়ম হলে তারা ব্যবস্থা নেন।

বিদেশে কর্মরত মেয়েদের খোঁজ নেওয়ার দায়িত্ব দূতাবাসের। জনবল সংকটের কথা বলে সে কাজটি করছে না দূতাবাস। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড রয়েছে কর্মীদের সুবিধা-অসুবিধা দেখতে। নির্যাতিত কর্মী দেশে ফেরার পর পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে দায়িত্ব সারছে সরকারের এই সংস্থাটি। এ বিষয়ে জানাতে ওয়েজ আর্নার্স বোর্ডের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ জুলহাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। জানিয়েছেন, পরে কথা বলবেন।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান সমকালকে বলেছেন, যেসব মেয়ে গৃহকর্মীর কাজে সৌদি আরব যান, তারা সবাই হতদরিদ্র। তাদের না আছে শিক্ষা, না আছে প্রশিক্ষণ। দালালের হাত ধরে তারা বিদেশ যান। কীভাবে যাচ্ছেন, কোথায় যাচ্ছেন, কোন রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের পাঠাচ্ছে- কিছুই জানেন না তারা। সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র ও অবহেলিত শ্রেণির মানুষ বলে তাদের ওপর নির্যাতন হলে তা আলোচনায় আসে না। কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায় না। এ কারণে নির্যাতনকারীর সাহস বেড়েছে। তারা জানে, বাংলাদেশি মেয়েদের নির্যাতন করলে শাস্তি পেতে হয় না।

গত বছর বিদেশ যান এক লাখ এক হাজার বাংলাদেশি নারী কর্মী। তাদের মধ্যে সৌদি আরব গেছেন ৭৩ হাজারের বেশি। নির্যাতন ও নানা অভিযোগে দেশে ফিরেছেন এক হাজার ২৩৪ জন। গত রোববার রাতে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন ৮১ নারীকর্মী, যারা গৃহকর্মীর কাজে দেশটিতে গিয়েছিলেন। তাদের সবাই কর্মক্ষেত্রে মারধর ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দেশে ফেরা ৮১ নারীর মধ্যে তিন কিশোরী চিকিৎসাধীন রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে। তারা সৌদি আরবে কর্মস্থলে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই তিন কিশোরী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। তাদের একজন আবার হারিয়ে ফেলেছে বাকশক্তি।

এই তিন কিশোরীর একজনের বয়স ১৬, অন্য দু'জনের ১৫ বছর বলে জানিয়েছেন তাদের বাবারা। অথচ সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজে পাঠাতে হলে নূ্যনতম বয়স ২৫ হতে হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক এই মেয়েদের পাসপোর্টে বয়স বেশি দেখিয়ে বিদেশ পাঠিয়েছিল দালালরা।

তিন কিশোরীর একজনের বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। কিন্তু পাসপোর্টে তার ঠিকানা লেখা নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার সাতগ্রাম ইউনিয়নের পাঞ্চরুখী গ্রাম। বাবা-মায়ের নামও ঠিক নেই। তথ্যের এমন গরমিল থাকার পরও কীভাবে পাসপোর্ট পেল এ কিশোরী! এ প্রশ্নে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক শাহাবউদ্দিন খান বলেছেন, তারা পাসপোর্ট দেন জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের ভিত্তিতে। তার সত্যতা খতিয়ে দেখে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)। এসবি যদি প্রতিবেদন দেয় তথ্য সঠিক, তাহলে পাসপোর্ট আটকানোর এখতিয়ার তাদের নেই।

এসবির বিশেষ পুলিশ সুপার (পাসপোর্ট) ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, তিনি নিজেও এমন তিন-চারটি ঘটনা পেয়েছেন সৌদি আরবগামী নারী কর্মীদের ক্ষেত্রে। পাসপোর্ট পেতে আবেদন ফরমে লেখা হয়েছে বয়স ২৭। কিন্তু প্রকৃত বয়স ১৫-১৬। তিনি এসব পাসপোর্ট আটকে দিয়েছেন। সমকালকে তিনি জানান, সৌদি আরবে ধর্ষণের শিকার কিশোরীর পাসপোর্টের পূর্ণাঙ্গ তথ্য পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।

পটুয়াখালীর কিশোরী উম্মে হানির বয়স ১৩ বলে জানিয়েছেন তার বাবা জাকির পেয়াদা। তিনি বলেছেন, স্থানীয় দালাল তাকে বলেন, সৌদি আরবে কাজে গেলে মাসে ২০ হাজার টাকা বেতন। এ লোভে তিনি রাজি হন। দালালকে ২০ হাজার টাকা দেন। মেয়ে কীভাবে, কোন এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ গেছে তা তিনি জানেন না। সব জানেন দালাল শহিদুল।

শহিদুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে হলে তিনি বলেন, ঢাকার কাকরাইলের ব্যবসায়ী আবুল খায়েরের কাছে উম্মে হানির কাগজপত্র দেন তিনি। তারপর পাসপোর্টসহ বাকি কাজ আবুল খায়ের করেছেন। তিনি ১০ হাজার টাকা পেয়েছেন মাত্র। আবুল খায়েরের ফোন নম্বরে তাকে পাওয়া যায়নি।

উম্মে হানির বাবা জানিয়েছেন, তার মেয়ে বিদেশ যাওয়ার পরপরই মারধর শুরু হয়। সারাদিন কাজ করানো হতো। বাড়ির সব কাজ তার মেয়েকে দিয়ে করানো হতো। ঠিকঠাক খাবার ও বেতন দেওয়া হতো না। তাই তার মেয়ে পালিয়ে সেফ হোমে আশ্রয় নেয়। মেয়ে এখনও ঢাকায়। তিনি মেয়ের অপেক্ষায় রয়েছেন।

অভিবাসী নারী কর্মীদের সংগঠন বমসার চেয়ারম্যান মিলি জাহান বলেছেন, বিদেশগামী নারী কর্মীরা পদে পদে প্রতারণার শিকার হন। বিদেশে যাওয়ার পর হন নির্যাতনের শিকার। সৌদি আরবে বাংলাদেশের মেয়েরা মারধর ও ধর্ষণের শিকার হলেও ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া বা অন্য কোনো দেশের মেয়েদের ওপর এমন ঘটনা ঘটে না। কারণ, ওই দেশগুলো তাদের মেয়েদের প্রতি যত্নশীল। নিয়মিত খোঁজখবর রাখে। বাংলাদেশের দূতাবাস সেই তুলনায় কিছুই করে না।

তবে এ দায় অস্বীকার করেছেন সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ। সমকালকে তিনি বলেন, সৌদি আরবে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু নির্যাতিত মেয়েরা মামলা করতে চান না। তার পরও দূতাবাস উদ্যোগ নিয়ে ৩৩টি মামলা করেছে। তার দাবি- নির্যাতিত মেয়েরা দ্রুত দেশে ফিরে যেতে যায়, তারা মামলার 'ঝামেলা'য় যেতে চায় না।

কোনো মামলায় দায়ীদের সাজা হয়েছে কি-না- এ প্রশ্নে গোলাম মসিহ বলেন, সাজা-খালাস আদালতের বিষয়। দূতাবাস আইনি লড়াই অব্যাহত রেখেছে।

নির্যাতনের শিকার হওয়ার আগে দূতাবাস কর্মস্থলে মেয়েদের খোঁজ-খবর নেয় কি-না এ প্রশ্নে রাষ্ট্রদূত বলেন, সৌদি আরব বিশাল আয়তনের দেশ। বাংলাদেশের মেয়ে রয়েছে কয়েক লাখ। তাদের শ্রম শাখায় জনবল মাত্র ১১ জন। তাই চাইলেও মাঠপর্যায়ে খোঁজখবর নিতে পারেন না। কিন্তু কোনো মেয়ে দূতাবাসে ফোন করতে পারলেই তাকে উদ্ধার করা হয়, সেফ হোমে আনা হয় ও পরে দেশে পাঠানো হয়।

অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর সমন্বয় অধ্যাপক ড. সি আর আবরার প্রশ্ন রেখে বলেন, দূতাবাসের যদি নির্যাতন প্রতিরোধের সক্ষমতা না থাকে, তাহলে এত বছরেও তারা কেন তা অর্জন করতে পারেনি। এটা পরিস্কার যে, নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য যে আন্তরিকতা প্রয়োজন, তা নেই তাদের।

নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও নারীকর্মী পাঠানো বন্ধ করাকে সমাধান মনে করেন না মিলি জাহান। সমাধান হিসেবে তিনি বলেছেন, যে রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী পাঠিয়ে দুই হাজার ডলার পায়, তার দায়িত্ব মাত্র তিন মাস খোঁজখবর রাখা। আইন করতে হবে- কর্মী যতদিন বিদেশ থাকবে, ততদিনই দায়িত্ব নিতে হবে এজেন্সিকে। কোনো মেয়ে নির্যাতিত হলে রিক্রুটিং এজেন্সির কাছ থেকে জবাব দিতে হবে মন্ত্রণালয়কে।

বাংলাদেশের মেয়েরা সৌদি আরবে কাজ করতে যাওয়ার পর প্রথম তিন মাস তার নিরাপত্তার দায়িত্ব রিক্রুটিং এজেন্সির। প্রত্যেক মেয়ের পরিবার ও দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার সুযোগ রাখা হয়েছে চুক্তিতে। গত রোববার যে ৮১ নারী দেশে ফিরেছেন, তাদের মধ্যে ১৬ জনের সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। তাদের মধ্যে চারজন জানিয়েছেন, চুক্তির সময়ের তিন মাস পেরোনোর পরই তাদের ‘বিক্রি’ করে দেওয়া হয়। যে বাড়িতে কাজ করতে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে অন্য বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার পরেই নেমে আসে নির্যাতন।

নির্যাতনের শিকার সুনামগঞ্জের এক কিশোরীর বাবা সমকালকে জানান, প্রথম তিন মাসে তার মেয়ে ৪৫ হাজার টাকা পাঠিয়েছিল। তারপর মেয়েকে আরেক শহরে কাজে পাঠানো হয়। সেখানে তাকে জানানো হয়, তারা তার মেয়েকে ‘কিনে’ এনেছে। তার পরই শুরু হয় 'জোর-জুলুম'। পরের জমিতে ঘর তুলে থাকা হতদরিদ্র এ বাবা জানান, স্থানীয় দালাল তার মেয়েকে সৌদি আরব পাঠিয়েছিল ২০ হাজার টাকা নিয়ে। চারটি মেয়ে তার। বিদেশ গেলে ভালো থাকবে, এ আশায় ঘরের টিন বেচে মেয়েকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। তার ১৪ বছর বয়সী মেয়ের কপালে দুঃখ হবে ভাবতেই পারেননি। মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে, তা জানাজানি হলে আত্মহত্যা ছাড়া তার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।

রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি বেনজির আহমদ এমপি বলেছেন, নারী কর্মী সৌদি আরব পাঠাতে কোনো এজেন্সিই টাকা নেয় না। টাকা নেওয়ার যে অভিযোগ, তা দালালরা নেয়। কর্মীদের বয়স বাড়ানোসহ ও পাসপোর্টে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার দায় এজেন্সির নয়; পাসপোর্ট অধিদপ্তর ও পুলিশের। বেনজির আহমদের দাবি- অনেক মেয়েই স্বামী-সন্তানের টানে দেশে ফিরতে নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ করে।

নানা অভিযোগ তুলে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল সৌদি আরব। পরে অন্য কোনো দেশ থেকে না পেয়ে ২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে বিনাখরচে নারী কর্মী নেওয়ার প্রস্তাব দেয় দেশটি। মাসিক মাত্র ৮০০ রিয়াল (১৬ হাজার টাকা) বেতনে গৃহকর্মী পাঠাতে ২০১৫ সালে রাজি হয় বাংলাদেশ। সৌদি আরব পুরুষ কর্মী নিয়োগের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। পুরুষ কর্মীদের জন্য সৌদি আরবের দরজা খোলা রাখতে বাংলাদেশ মেয়ে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে বলে জানিয়েছে জনশক্তি খাত সংশ্নিষ্ট একাধিক সূত্র।

ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠায় না। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলংকাও দেশটিতে নারী পাঠায় না। ২০১১ সালে সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেয় ফিলিপাইন। দেশটির সংসদীয় প্রতিনিধি দলের তদন্তে প্রকাশ পায়, দেশটিতে প্রবাসী নারী কর্মীদের ওপর নির্যাতন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সূত্র: সমকাল।

বিডি২৪লাইভ/টিএএফ

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: