জীবনকে নিয়ে জুয়া খেলেছিলেন যে কবি 

প্রকাশিত: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯, ০৬:২০ পিএম

বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে একটি চিঠিতে মধুসূদন দত্ত লিখেছিলেন, ‘আমি দেখা দেব বিশাল এক ধূমকেতুর মতো।’ কোন কোন সময় নিজের সম্বন্ধে অতিরঞ্জিত কথা বললেও রাজনারায়ণকে তিনি নির্ভেজাল সত্য কথা বলেছিলেন। সাহিত্যের মতো জীবনেও তিনি ধূমকেতু। নিয়মের পথে, বাঁধা পথে চলে না ধূমকেতু। সে উৎকেন্দ্রিক। তার চকিত আলোয় আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তাকে বাঁধাপথের পথিকদের মনে হয় সৃষ্টিছাড়া কাজ। এমন কি ভয়ও করি তাকে।

যশোরের সাগরদাঁড়ির রাজনারায়ণ দত্তের ছেলে মধু। ঐশ্বর্যের মধ্যে মানুষ। অতি আদরের সন্তান। বাপের মতো উকিল হয়ে টাকা-পয়সা সোনা-দানায় ঘর ভরিয়ে ফেলবে তেমনি আশা অভিভাবকদের। সেই ছেলে বাবার সঙ্গে কলকাতায় এল, লালবাজার গ্রামার স্কুলে ভর্তি হল, সেখান থেকে হিন্দু কলেজ। তখন ডিরোজিও নেই, কিন্তু তাঁর প্রভাব আছে। আছেন ডি এল আর অর্থাৎ রিচার্ডসন। যিনি সেই তরুণের চোখের সামনে মেলে ধরলেন ইংল্যান্ড তথা ইউরোপের রোমান্টিক কবিদের জগতটাকে। সেই সূত্রে গ্রাম্য বালকটি হয়ে উঠল আধুনিক। মান্ধাতার আমলের বস্তাপচা জীবনধারণ নয়, জীবনধারণ করতে হবে ইংরেজদের মতো, লিখতে হবে এই ভাষায় কবিতা। আর সেসব করতে হলে যেতে হবে সেই শ্বেতদ্বীপ-ইংল্যান্ড।

হিসেবী লোক রাজনারায়ণ। ছেলের মতিগতি দেখে বুঝতে পারছিলেন তাকে বাঁধতে হবে। সেকালের মানুষের যেমন ভাবনা, বাঁধন হবে বিয়ে দিলে। পাত্রীও ঠিক করে ফেললেন। বয়স কম হলেও সুন্দরী। এরকমই চলে আসছিল তখন। বাবার দেখা পাত্রীকেই নিরুচ্চারে বিয়ে করেছিলেন মধুর বন্ধু গৌরদাস বসাক, ভূদেব মুখার্জী, রাজনারায়ণ বসু। কিন্তু মধু তো বাঁধা পথে চলেন না। বাবা কেন পাত্রী নির্বাচন করে দেবেন, করবেন পাত্র নিজে, কোর্টশিপ হবে, তারপর বিয়ে। ১৮৪০ সালে মধুর এই ভাবনা এখনকার ভাবনা, তখন ছিল সৃষ্টিছাড়া ভাবনা।

বিয়ে এড়াবেন কি করে! খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে। এই ধর্মের প্রতি তাঁর যে আলাদা কোন মোহ ছিল তা নয়। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করলে এক ঢিলে মারা যাবে দুই পাখি- বিয়ে যেমন এড়ানো যাবে তেমনি বিলেত যাবার পথ হবে সুগম। তাঁকে ফোর্ট উইলিয়মে লুকিয়ে রাখা হল যাতে বাবা কোন খোঁজ না পান। দীক্ষা হয়ে গেল। কিছুদিন ওল্ড চার্চে, কিছুদিন মি. স্মিথের বাড়ি কাটালেন। বুঝতে পারলেন খ্রিস্টান হলেই বিলেত যাবার পথ সুগম হয় না। তাঁর ঘরে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেল। তবু বাবার মনের পথ বন্ধ হয়নি। বিশপস কলেজে ভর্তি করে দিলেন এবং আশা করে থাকলেন ভুল বুঝতে পেরে মধু আবার স্বধর্মে ফিরে আসবে। তা যখন হল না তখন তিনি মধুকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। রুপোর চামচ মুখে নিয়ে যে জন্মেছিল সে পড়ল অকুল সাগরে। দেখল যারা তাকে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণে উৎসাহিত করেছিল তারা তার জীবিকানির্বাহের ব্যাপারে একেবারে উদাসীন। মা-বাবার জন্য মনে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু কবি পোপের বাণী ছিল সান্ত্বনার সম্বল: কবিতার জন্য পরমাত্মীয়কেও ত্যাগ করতে হয়।

আবার জীবনকে বাজি রাখার পালা। চলে গেলেন মাদ্রাজ। অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবেই। মাদ্রাজ মেইল আ্যন্ড বয়েজ স্কুলে একটা চাকরি জুটল। মাইনে ৪৬ টাকা। সেখানে অনাথ ও সহায়হীন রেবেকার সঙ্গে আলাপ, তারপর বিয়ে। এত কম টাকায় সংসার চলে না, তাই পত্র-পত্রিকায় লিখে রোজগারের চেষ্টা। হিমসিম খাচ্ছেন, কষ্ট হচ্ছে, তবু সংসারজীবনটা সুখের ছিল। দেখতে দেখতে চার-চারটি সন্তানের জনক হলেন। ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনার ইচ্ছেটা জীবন্ত। লিখে ফেললেন ক্যাপটিভ লেডি, ভিজন অফ দি পাস্ট, কিছু খুচরো সনেট। লিখলেন বটে, জনসমাদর হল না। ইতোমধ্যে আলাপ হয়েছে হেনরিয়েটার সঙ্গে। তারপরে একদিন দুম করে চলে এলেন কলকাতায়। বাহ্য কারণ: বাবার মৃত্যুর পর পৈতৃক সম্পত্তি উদ্ধার। আর ফিরে গেলেন না মাদ্রাজ। পড়ে রইল রেবেকা, পড়ে রইল তাঁর চার সন্তান-বার্থা, ফিবি, জর্জ, মাইকেল। আবার কক্ষচ্যুত মধু হেনরিয়েটার মধ্যে সন্ধান করতে লাগলেন নতুন কক্ষপথের। হেনরিয়েটাও চলে এলেন কলকাতায়। বিয়ে হল না কোনদিন কিন্তু দুজনে থাকলেন স্বামী-স্ত্রীর মতো।

৬ বছর কলকাতায় ছিলেন। এই ৬ বছরেই ধূমকেতুর মতো প্রজ্বলিত করে তুললেন বাংলা সাহিত্যকে। একে একে বেরুতে লাগল শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী, বুড় শালিখের ঘাড়ে রোঁ, একেই কি বলে সভ্যতা, কৃষ্ণকুমারী, মেঘনাদবধ, বীরাঙ্গনা, ব্রজাঙ্গনা। মাত্র এই ৬ বছরের সাধনায় তিনি আধুনিক বাংলা কাব্য ও নাটকের জনকের খ্যাতি পেলেন। এরকম ঘটনা বাংলা সাহিত্যে তো বটেই পৃথিবীর সাহিত্যেও দুর্লভ। কলকাতায় থেকে গেলে সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা বৃদ্ধি পেত, পৈতৃক সম্পদ হস্তগত হত, জীবিকার পথও ধীরে ধীরে সুগম হত। কিন্তু ধূমকেতু তো বাঁধা পথে চলে না। তাই ইংল্যান্ড যেতে হবে, ব্যারিস্টার হতে হবে, বাবার চেয়ে বেশি রোজগার করে থাকতে হবে রাজকীয় বৈভবে। পৈতৃক সম্পত্তি বন্ধক রেখে কিছু অর্থ হাতে পেয়ে হেনরিয়েটা ও শিশুপুত্রকে ফেলে রেখে চলে গেলেন ইংল্যান্ড। অপরাধবোধ একটা ছিল, রাজনারায়ণ বসুকে লিখেছিলেন, ‘বন্ধু, আমি আমার স্বদেশের সাহিত্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, আশা করি সেটা তুমি নিশ্চয়ই মনে করবে না।’ 

নিজের তালুক পত্তনি দিয়ে গেলেন মাসে মাসে টাকা পাবেন বলে। কিন্তু যার কাছে পত্তনি রাখলেন এবং যাদের জামিন রাখলেন তারা যে কথা রাখবে তার কোন নিশ্চয়তা আছে কিনা ভেবে দেখলেন না। একেবারে অজানা জায়গায় এরকম ভাগ্য পরীক্ষা ধূমকেতুর পক্ষেই সম্ভব।এর মধ্যে দেনার দায়ে অস্থির হয়ে হেনরিয়েটাও চলে এলেন সন্তানদের নিয়ে। ব্যারিস্টারির তখনও দুটো টার্ম বাকি। খরচ কম হবে ভেবে আবার নিলেন হঠকারী সিদ্ধান্ত। ইংল্যান্ডের শহরতলীতে না থেকে চলে এলেন ফ্রান্সের ভার্সাইতে। পত্তনি থেকে তাঁর টাকার ব্যবস্থা করার জন্য বিদ্যাসাগর অনেক করেছেন তাঁর জন্য।

শেষ পর্যন্ত ব্যারিস্টার হয়ে ফিরলেন দেশে। কিন্তু হেনরিয়েটা ও সন্তানদের রেখে এলেন ভার্সাইতে। কি না, এখানে পসার জমিয়ে অনেক টাকা রোজগার করে নিয়ে আসবেন তাঁদের। নানা টালবাহানার পর কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মধুকে এডভোকেট হিসেবে গ্রহণ করলেন। বিদ্যাসাগর মধুর আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে তাঁর বাড়িতে থাকার কথা বলেছিলেন। সে বিবেচনা মধুর ছিল না। তিনি উঠেছিলেন স্পেন্সেস হোটেলে। কিন্তু ভৃত্যপরিবৃত এই ব্যয়বহুল হোটেলের শয্যা তাঁর কাছে কণ্টকশয্যা হয়ে উঠল। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। বাড়ছে ঋণের বোঝা। মধুর বেহিসেবী স্বভাবে, অবিবেচনার পর অবিবেচনায় অতিষ্ঠ বিদ্যাসাগরও। মানুষের সঙ্গে মিশতে না পারা, সওয়াল-জবাবের সময় আইনের কথা উল্লেখ না করে কবিতা আওড়ানো ইত্যাদির ফলে পসার জমল না। অতিষ্ঠ হেনরিয়েটাও হচ্ছিলেন। তাই তিনি ফিরে এলেন কলকাতায় স্বামীর কাছে। দেখলেন ঋণের বোঝা কমে নি, শরীরও জীর্ণ, ৪৫ বছর বয়সেই মধুকে প্রৌঢ়ত্ব গ্রাস করেছে। তারপরে জীবিকা অর্জনের জন্য কত বিচিত্র কাজ করতে হয়েছে তাঁকে—প্রিভি কাউন্সিলের রেকর্ডের পরীক্ষক, পঞ্চকোটের রাজার ম্যানেজারি...। কলকাতায় এসে উঠেছিলেন অভিজাত হোটেলে, সেখান থেকে যেতে হল এন্টালির বস্তিতে। এর মধ্যে লেখা হয়েছে হেক্টরবধ আর মায়াকানন ; কিন্তু ধূমকেতু তখন যে অতিত্রুত ধ্বংসের দুর্নিবার আকর্ষণে ছুটে চলেছে অতল গহ্বরের দিকে।

১৮৭৩ সাল। মার্চ মাস। মধু আর হেনরিয়েটার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। তবু তার মধ্যে কন্যা শর্মিষ্ঠার বিয়ে দিতে পেরেছেন। উঠেছেন উত্তরপাড়া লাইব্রেরির উপরতলার একটা ঘরে। বন্ধু গৌরদাস দেখতে গিয়ে দেখলেন: বিছানায় রোগ ষন্ত্রণায় ছটফট করছেন মধু, রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে মুখ দিয়ে, হেনরিয়েটা পড়ে আছেন মেঝেতে, এ ওকে দেখতে বলছেন। চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা নেই। সেখান থেকে কলকাতায়, হেনরিয়েটা গেলেন তাঁর জামাইএর বাড়িতে, মধুকে রাখা হল আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে। হেনরিয়েটা মারা গেলেন ২৬ জুন, তার তিনদিন পরে মারা গেলেন মধু। কিন্তু পরিহাসের তখন বাকি ছিল কিছু। সময়মতো অন্ত্যেষ্টি হয়নি আধুনিক বাংলা কাব্যের এই জনকের। মৃত্যুর পরেও চব্বিশ ঘন্টা তাঁর মৃতদেহ পড়ে রইল মর্গে।  নিঃসহায় অনাথ মানুষের মতো। কারণ তাঁর প্রতি খ্রিস্টানসমাজের রোষ ও বিরূপতা। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় মধুর স্বীকারোক্তি নিতে এসেছিলেন, কিন্তু মধুর মৃত্যুর পরে তাঁর অন্ত্যেষ্টির কোন সুব্যবস্থা করতে পারেন নি। শেষ পর্ষন্ত লোয়ার সার্কুলার রোডের সেন্ট জেমসেস চার্চের প্রধান পাদ্রি রেভারেন্ড পিটার জন জার্বোর উদ্যোগে সমাধিস্থ করা হয় মধুসূদনের মৃতদেহ।

শ্বেতাঙ্গিনীকে বিয়ে করার জন্য খ্রিস্টানসমাজ মধুসূদের উপর বিরূপ হয়েছিলেন। কিন্তু দয়ার সাগর বিদ্যাসাগরও কি বিরূপ হয়ে ছিলেন মধুর উপর? মধুর অতলান্ত অবিবেচনায় বিরক্ত হবারই কথা। বিরক্ত হয়ে কি বিদ্যাসাগর আসেন নি তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়? না, তা নয়। একটা তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছিলেন বিদ্যাসাগর: জীবিত অবস্থায় যাকে বাঁচাতে পারলাম না, কি হবে তার অন্ত্যেষ্টিতে গিয়ে? কি করে বাঁচাবেন বিদ্যাসাগর? ধূমকেতুকে কে কবে বাঁচাতে পেরেছে? সে তো মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে পতনের ঘোর আকর্ষণে ছুটে চলে মৃত্যুর দিকে।
লেখক:- দিলীপ মজুমদার, কলকাতা।

বিডি২৪লাইভ/এমআর

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: