অমর একুশের চেতনা বাঙালি জাতির কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ

প্রকাশিত: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:৩৯ এএম

অ্যাডভোকেট শেখ সালাহ্উদ্দিন আহমেদ: মানুষের আবেগ-অনুভূতি সব কিছুই ব্যক্ত হয় মাতৃভাষায়। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, গর্বের ভাষা। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও এ ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের স্বাধীন দেশ আছে, আছে অতিসমৃদ্ধ এক ভাষা। তবে এ ভাষার জন্য অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছে।

অমর একুশের চেতনা বাঙালি জাতির কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বুকের রক্ত দিয়ে গেছেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেকে। বিনিময়ে আমরা পেয়েছি বাংলা ভাষা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে সমুন্নত করেন। কিছু দিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়ছে, বিশ্বময় বাংলা ভাষা ছড়িয়ে পড়ছে।

আন্তর্জাতিকভাবে আজ এই ভাষা স্বীকৃত। আজ আমাদের ভাষা দিবস বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়, যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্‌যাপিত হয়। এর চেয়ে গৌরবের আর কী থাকতে পারে। কিন্তু আমরা এখনো এই ভাষার মর্যাদা যথাযথভাবে দিতে পারিনি। ১৯৮৭ সালে দেশে আইন করা হয় যে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার ও প্রয়োগ করা হবে। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই ইংরেজির ব্যবহার বাংলা ভাষার মর্যাদা নষ্ট করে দিচ্ছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে তা মোটেই সুখকর নয়। এখনও দেশের বিজ্ঞজনদের অনেকেই সভা-সমিতিতে ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করেন। তাঁদের কথা যে সবাই বুঝতে পারছে না, সেটা জেনেও তাঁরা তা করেন। এর মাধ্যমে আমাদের চেতনার মধ্যে ঔপনিবেশিক মানসিকতার ছাপ স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। বছরের এই একটিমাত্র দিনে আমরা বাংলা ভাষার মর্যাদা, ভাষাকে উর্ধ্বে তুলে ধরা নিয়ে অনেক কথা বলে থাকি। শহীদ মিনার রং করি, আলপনা আঁকি, শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রভাতফেরি করি। আর সারা বছর এর কোনো সম্মান রক্ষা করি না।

প্রজাতন্ত্রের মালিক মোক্তার সাধারণ মানুষের ভাষা যেহেতু বাংলা, সেহেতু সর্বস্তরে বাংলা প্রচলিত না হওয়া দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আবেগের প্রতি উপেক্ষার শামিল। আশার কথা, কোনো কোনো মহলের নিষ্ক্রয়তা সত্ত্বেও সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের তাগিদ ক্রমেই উচ্চকিত হচ্ছে। উচ্চ আদালত ও সর্বোচ্চ আদালতেও বাংলায় রায় লেখা এবং অন্যান্য কাজ সম্পাদনের প্রাসঙ্গিকতা সবার বিবেচনায় আসছে। আমার বিশ্বাস আদালতের তাৎপর্যপূর্ণ এই নির্দেশ উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রেও উৎসাহ সৃষ্টি করবে। এ ক্ষেত্রে যেসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার প্রয়াস শুরু হবে।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ থেকে দেওয়া নির্দেশ, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার চালুর ক্ষেত্রে সর্বশেষ তাগিদ বলে বিবেচিত হবে। বস্তুত যে মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা আদায়ে এ দেশের দামাল তরুণরা রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল, ছয় দশক পরও সেই ভাষা সর্বস্তরে কেন চালু হচ্ছে না, এই বিস্ময় আমাদের অনেকের।

বাংলা ভাষার ভিত্তিতে যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সূচিত হয়েছিল, সেই রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার অধিষ্ঠান নৈতিক দায়িত্ব তো বটেই; আমরা দেখি, সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদও এ বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। সেখানেই শেষ নয়; ১৯৮৭ সালের মার্চ মাসে প্রণীত ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ স্পষ্ট করে দিয়েছে যেথ ‘সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের (বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত) সব ক্ষেত্রে ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।’ তারপরও বাংলা ভাষার প্রচলন সর্বস্তরে সম্ভব না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক।

আমরা জানি, দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ বাংলা ভাষাতেই কথা ও কাজ চালিয়ে থাকে। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবেও বাংলা সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু দাফতরিক যোগাযোগ এবং বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের লৈখিক তৎপরতায় ইংরেজিরই প্রাধান্য। এর একটি কারণ সম্ভবত ঔপনিবেশিক আমলের ভিত্তিমূলে গড়ে ওঠা আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মানসিকতা। আমরা দেখি, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানির মতো প্রভাবশালী দেশ তো বটেই, বুলগেরিয়া, তুরস্কের মতো অপেক্ষাকৃত কম প্রভাবশালী দেশও নেহাত প্রয়োজন ছাড়া ইংরেজি ব্যবহার করে না।

ভাষার জন্য জীবন দেওয়া এবং বিদেশি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রক্তস্নাত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে তা সম্ভব হবে না কেন? বাংলা ভাষার গৌরব, বিজ্ঞানসম্মত কাঠামো এবং বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতিও এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক। আমরা আশা করি, বাংলা ভাষা প্রচলন আইন অনুসারে সব ক্ষেত্রে অবিলম্বে বাংলা ভাষা ব্যবহারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে যে রুল আদালত দিয়েছে, তা সরকার প্রতিপালনে বিলম্ব করবে না। উচ্চ আদালতেও বাংলা ভাষার ব্যবহার সামান্য থাকার যে সমালোচনা রয়েছে, খোদ বিচার বিভাগকেও সেদিকে নজর দিতে হবে। সব পক্ষ উদ্যোগী ও আন্তরিক হলে বাংলা ভাষার মর্যাদা ও ব্যবহার বাড়ানো অবশ্যই সম্ভব।

১৯৯৯ সালে সরকারি জোর প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। অত্যন্ত দুঃখজনক যে আমরা আমাদের ভাষাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারছি না। সাইনবোর্ড লেখা হয় ইংরেজিতে। বাংলা লেখা হলে বানানে থাকে ভুল। বাংলা একাডেমিও এ ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু সফলতা আসেনি। তাই সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, বাংলা ভাষা সংরক্ষণে আরো জোরদার ভূমিকা রাখতে হবে। এ দেশে এখনো অনেক ভাষাসৈনিক জীবিত আছেন, যাঁরা অতিকষ্টে জীবন যাপন করছেন। তাঁদের পাশে সবাইকে দাঁড়াতে হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও সভাপতি সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম এবং প্রধান সম্পাদক দৈনিক আজকের অগ্রবাণী।

বিডি২৪লাইভ/টিএএফ

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: