যেভাবে পতন হল আফ্রিকার আরেক স্বৈরশাসক ওমর আল-বশিরের

প্রকাশিত: ১২ এপ্রিল ২০১৯, ১১:৪০ এএম

উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশ সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির পদত্যাগ করেছেন। সে দেশের সামরিক বহিনী ও জনগণের প্রতিবাদে মুখে বৃহস্পতিবার তিনি পদত্যাগ করেন। এই দিনই দেশটিতে সেনাবাহিনীর দেয়া এক খসড়া অনুযায়ী অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে বলে একটি সামরিক সূত্র জানায়।

বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) সকালেই সুদানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও রেডিওতে বলা হয় ‘সেনাবাহিনী একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দেয়।’ এরপর বশিরের পদত্যাগের খবর সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

যেভাবে সুদানে শুরু হয়েছিল ওমর আল-বশিরের শাসনামল, অবশেষে সেভাবেই সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। আল-বশিরকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দু’বছরের জন্য অন্তবর্তীকালীন দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে দেশটির সামরিক কাউন্সিল। তার ক্ষমতাচ্যুতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী আওয়াদ ইবনে ওউফ।

তিনি বলেন, তিন মাসের জন্য দেশটিতে জরুরি অবস্থা এবং একমাসের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে।

আওয়াদ ইবনে ওউফ বলেন, ওমর আল-বশিরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং একটি নিরাপদ স্থানে রাখা হয়েছে।

কয়েক দশকের যুদ্ধ

আল-বশিরের রাজনৈতিক জীবনকে যুদ্ধ দিয়েই সবচেয়ে ভালোভাবে বর্ণনা করা যায়। ১৯৮৯ সালে তিনি ক্ষমতায় আসেন এবং শক্ত হাতে দেশ পরিচালনা করেছেন। ২০১১ সালে বিভক্ত হয়ে দক্ষিণ সুদানের জন্ম না হওয়া পর্যন্ত এই দেশটি ছিল আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশ।

যখন তিনি ক্ষমতা দখল করেন, সুদান তখন উত্তর আর দক্ষিণের মধ্যে ২১ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের মধ্যে রয়েছে।

বশির শক্ত হাতে জবাব দিতে শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে দমন পীড়ন এবং যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত।

তার বিরুদ্ধে ২০০৯ ও ২০১০ সালে দুটি আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারের পরোয়ানা জারি করা হয়। যদিও তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও তিনি ২০১০ ও ২০১৫ সালের দুইটি নির্বাচনে বিজয়ী হন। তার সর্বশেষ নির্বাচন বিরোধীরা বর্জন করে।

এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে তার ওপর আন্তর্জাতিক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা তৈরি হয়। তারপরেও বশির মিসর, সৌদি আরব আর দক্ষিণ আফ্রিকায় ভ্রমণ করেন।

২০১৫ সালের জুনে তিনি অনেকটা বিব্রতকর ভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা ত্যাগ করতে বাধ্য হন, কারণ দেশটির একটি আদালত বিবেচনা করছিল যে, তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটি কার্যকর করা হবে কিনা।

একীভূত সুদান

ক্ষমতা গ্রহণের আগে সেনাবাহিনীর একজন কমান্ডার ছিলেন মি. বশির। তিনি বিদ্রোহী নেতা জন গ্যারাঙ্গের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ অভিযান পরিচালনা করেন।

যখন তিনি সুদানিজ পিপলস লিবারেশন মুভমেন্টের পক্ষে গ্যারাঙ্গের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন, তখন তিনি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন যাতে চুক্তিটি পরাজয় বলে মনে না হয়।

তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা অসহায় হয়ে ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করিনি, বরং আমরা যখন বিজয়ের শীর্ষে ছিলাম, তখনি তাতে স্বাক্ষর করেছি।’

তার সবসময়েই লক্ষ্য ছিল একটি একীভূত সুদান রক্ষা করা, কিন্তু শান্তি চুক্তির অংশ হিসাবে দক্ষিণ সুদানের বিষয়ে একটি গণভোট আয়োজন করতে বাধ্য হন।

২০১১ সালের জানুয়ারির গণভোটে ৯৯ শতাংশ দক্ষিণ সুদানিজ ভোটার আলাদা হয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেন। ছয় মাস পরে স্বাধীন দক্ষিণ সুদান ঘোষিত হয়।

যখন তিনি দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতার পক্ষে সম্মত হন, তখনো দারফুরের প্রতি তার মনোভাব ছিল আগ্রাসী।

কিন্তু কৃষ্ণাজ্ঞদের ওপর নির্যাতনের কারণে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত আরব জানহাওয়েড মিলিশিয়াদের তিনি সমর্থন করেছেন বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেসব অভিযোগ করেছে, তা তিনি বরাবরই অস্বীকার করে গেছেন।

ওমর আল-বশিরের বিরুদ্ধে আইসিসির যেসব অভিযোগ রয়েছে, তার মধ্যে আছে গণহত্যা, হত্যা, জোর করে বাস্তুচ্যুত করা, ধর্ষণ, নির্যাতন, দারফুরে বেসামরিক লোকজনের ওপর হামলা, গ্রাম ও শহরে লুটতরাজ করা।

সামরিক মনোভাব

বশিরের জন্ম হয় ১৯৪৪ সালে উত্তর সুদানের একটি খামারি পরিবারে। সে সময় সেই এলাকাটি ছিল মিসরীয় রাজত্বের অংশ। তিনি একটি বেদুইন গোত্রের সদস্য ছিলেন।

তরুণ বয়সে তিনি মিসরীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ১৯৭৩ সালে ইসরাইলে বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পর কর্মকর্তা পদে উন্নীত হন।

তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কমই জানা যায়। তার কোনো সন্তান নেই এবং ৫০ বছর বয়সের দিকে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। তিনি সুদানের উত্তরের যুদ্ধ বীর হিসাবে পরিচিত ইব্রাহিম শামস আল-দ্বীনের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করেন।

সংকট ও বিক্ষোভ

সম্প্রতি দেশটিতে রাজনৈতিক বিক্ষোভ জোরালো হয়ে ওঠে। সরকার তেল ও রুটির দাম বাড়ানোর পর তার ৩০ বছরব্যাপী শাসনামলের মধ্যে গত ডিসেম্বরে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ শুরু হয়।

গত কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিকভাবে সংকটে ভুগছে সুদান, বিশেষ করে দক্ষিণ সুদান আলাদা হয়ে যাওয়ার পর। কারণ দেশের মোট উত্তোলিত তেলের চারভাগের তিনভাগই রয়েছে দক্ষিণ সুদানে।

মুদ্রামান করে যাওয়া ও জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংকটে পড়েছে দেশের মানুষজন।

বশিরের শাসনামলে দেশটি ২০১৮ সালের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭২ নম্বরে রয়েছে।

সর্বশেষ প্রতিরোধ

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি এক বছর মেয়াদি জরুরি অবস্থা জারি করেন বশির। তার মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন আনেন এবং দেশের সব স্টেট সরকারের গভর্নরদের সরিয়ে দিয়ে সেখানে সামরিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বসিয়ে দেন।

কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবিও নাকচ করে দেন। তার দাবি, বিক্ষোভকারীরা ২০২০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে তাকে সরিয়ে দিতে পারবে।বিক্ষোভকারীদের ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ ওঠে সরকারের বিরুদ্ধে।

কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে, গত ডিসেম্বরে শুরু হওয়া বিক্ষোভে ৩৮ জন নিহত হয়েছে, যদিও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বাস্তবে এই সংখ্যা অনেক বেশি।

জাতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিভাগ জানিয়েছে, তারা সকল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে যাচ্ছে।কিন্তু এটা এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয় যে, সামরিক বাহিনী সুদানের স্থায়ীভাবে থেকে যেতে চাইবে কিনা।

বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তারা চান না, একজন কর্তৃত্ববাদী শাসকের বদলে আরেকজন সেইরকম শাসক ক্ষমতায় আসুক।

সুতরাং যখন বশিরের পতনে আনন্দ করছে সুদানের লোকজন, তখন ভবিষ্যতে কোন শাসক আসছে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে উদ্বেগও রয়েছে।

বিডি২৪লাইভ/এসএএস/এমআর

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: