২০০ বছরের নির্মাণ আগুনে ছারখার কয়েক ঘণ্টায়

প্রকাশিত: ১৬ এপ্রিল ২০১৯, ০৯:৫৮ এএম

ইউরোপের দেশ ফ্রান্সের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনার একটি প্যারিসে মধ্যযুগীয় নটরডাম ক্যাথেড্রাল সোমবার (১৫ এপ্রিল) আগুনে অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। ৮৫০ বছরের প্রাচীন ভবনটি পুরোপুরি তৈরি করতে সময় লেগেছিল দুই শতক।

সোমবার নটরডাম ক্যাথেড্রালে আগুন লাগার পর বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গির্জাটি দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতক ধরে নির্মাণ করা হয়।

তবে অগ্নিকাণ্ডের পর মূল কাঠামো এবং দুটো বেল টাওয়ার রক্ষা করা গেছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

প্রাচীন গোথিক ভবনটিকে রক্ষার জন্য দমকল কর্মীরা ব্যাপক চেষ্টা চালালেও এর উঁচু মিনার এবং ছাদ ধ্বসে পড়ে।

অগ্নিকাণ্ডের কারণ এখনো পরিষ্কার নয়, তবে কর্মকর্তারা বলছেন, চলমান সংস্কার কাজের সাথে কোনও যোগসূত্র থাকতে পারে। ক্ষয়িষ্ণু ভবনটি রক্ষার জন্য গতবছর ফ্রান্সের ক্যাথলিক চার্চ তহবিলের আহ্বান করেছিল।

যেভাবে আগুন ছড়িয়ে পড়ে

স্থানীয় সময় সাড়ে ছয়টার দিকে আগুন লাগে এবং দ্রুত তা ছাদে ছড়িয়ে পড়ে। ক্যাথিড্রালের ছাদে যখন আগুন জ্বলতে থাকে এবং ভবনের জানালা ধ্বংস করে দেয় তখন প্রকাণ্ড জোরে শব্দ শোনা যায়।

উচু মিনার খসে পড়ার আগে তা কাঠের তৈরি কাঠামো ধংস করে । একটি বেল টাওয়ার ধ্বসের হাত থেকে রক্ষার জন্য ৫০০ জন ফায়ার ফাইটার কাজ করে।

চার ঘণ্টা পরে অগ্নিনির্বাপণ বাহিনীর প্রধান জ্যঁ-ক্লদে গ্যালেট বলেন, প্রধান কাঠামোটি পুরোপুরি ধ্বংসের কবল থেকে ‘রক্ষা করা গেছে এবং সংরক্ষিত’ আছে।

ক্যাথেড্রালের শিল্পকর্ম সংরক্ষণ এবং এর উত্তরাংশে টাওয়ার রক্ষার জন্য রাতভর সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়। ক্যাথেড্রালের আশেপাশের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন, আগুনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করবার জন্য।

অনেককে প্রকাশ্যে কাঁদতে দেখা যায়, একই সময়ে অন্যরা দুঃখ করছিলেন, কেউবা প্রার্থনা করছিলেন। রাজধানীর অনেক গির্জায় বেল বাজাতে শোনা যায়।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রো ঘটনাস্থলে পৌঁছে সকল ক্যাথলিক এবং ফরাসি নাগরিকের জন্য তার সমবেদনার কথা জানান।

তিনি বলেন, ‘আমাদের এই অংশটি পুড়তে দেখে আমার দেশের আর সবার মত আমিও আজকের রাতে অত্যন্ত ব্যথিত’।

ম্যাক্রো বলেন, ‘আমরা একত্রে পুনরায় তৈরি করবো নটরডাম’। তিনি ফায়ার ফাইটারদের চূড়ান্ত সাহসিকতা এবং পেশাদারিত্বের প্রশংসা করেন।

মিস্টার ম্যাক্রো এর আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ টেলিভিশন বক্তৃতা দেয়ার কথা থাকলেও অগ্নিকাণ্ডের কারণে তা বাতিল করেছেন বলে এলিজি প্রাসাদ কর্মকর্তারা জানান।

ইতিহাসবিদ কামিলি পাস্কাল ফরাসি গণমাধ্যম বিএফএমটিভিকে বলেন, আগুন ধ্বংস করে দিচ্ছে ‘অমূল্য ঐতিহ্য’। ৮০০ বছর ধরে এই ক্যাথেড্রাল প্যারিসে দাঁড়িয়ে ছিল।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খুশির এবং দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় নটরডামের ঘণ্টাধ্বনি তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে।

প্যারিসের মেয়র অ্যানি হিদালগো সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরা যে সীমানা বেষ্টনী তৈরি করে দিয়েছে নিরাপত্তার স্বার্থে তারা যেন তা মান্য করে।

‘ভেতরে প্রচুর সংখ্যক শিল্পকর্ম রয়েছে...এটা একটা সত্যিকারের ট্রাজেডি’, তিনি সাংবাদিকদের বলেন।

একটি দেশের প্রতীক

বিবিসি ওয়ার্ল্ড অনলাইনের হেনরি আস্টয়ের-এর বিশ্লেষণ অনুসারে, নটরডামের মত অন্য কোন নিদর্শন বা জায়গা ফ্রান্সের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। জাতীয় প্রতীক হিসেবে এর কাছাকাছি প্রতিদ্বন্দ্বী আইফেল টাওয়ার।

১২০০ শতক থেকে প্যারিসে দাঁড়িয়ে ছিল নটরডাম। ভিক্টর হুগোর ‘দ্য হাঞ্চব্যাক অব নটরডাম’ ফরাসিদের কাছে নটরডাম ডি প্যারিস হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছিল। এই ক্যাথেড্রালটি সর্বশেষ বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের সময়।

&dquote;&dquote;
নটরডাম ক্যাথেড্রাল

নটরডাম সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য

১. প্রতি বছর নটরডাম ক্যাথেড্রাল দেখতে এক কোটি ৩০ লাখ দর্শনার্থী ( ১৩ মিলিয়ন) আসেন।

২. এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটিজে সাইট যা ১২ এবং ১৩ শতক জুড়ে নির্মিত হয়েছিল এবং বর্তমানে এর বড় ধরনের সংস্কারকাজ চলছিল।

৩. সংস্কার কাজের জন্য ঢোকার মুখের বেশ কয়েকটি প্রতিমা সরানো হয়েছিলো।

৪. ভবনের ছাদের বেশিরভাগই ছিল কাঠ দিয়ে তৈরি, যা আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

দুই বিশ্বযুদ্ধের ধকল থেকে এটি টিকে গিয়েছিল।

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একটি জাতির অটলতার প্রতিমূর্তির এভাবে পুড়তে এবং মিনার চোখের সামনে গুড়িয়ে যেতে দেখা যেকোনো ফরাসি নাগরিকের জন্য বিরাট এক ধাক্কা।

প্রত্যক্ষদর্শী সামান্থা সিলভা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব দেশের বাইরে থাকে এবং যখনই তারা আসে প্রতিবার আমি তাদের বলি নটরডাম বেরিয়ে এসো’।

‘অনেকবার আমি সেখানে গেছি, কিন্তু কখনোই একরকম মনে হয়নি। এটা প্যারিসের সত্যিকারের প্রতীক’।

বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া

প্রাচীন এই স্থাপনায় আগুনের ঘটনায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরামর্শ দিয়েছেন যে, ‘সম্ভবত উড়ন্ত জল-কামান’ এই আগুন নেভাতে কার্যকর হতে পারে। জার্মান চ্যাঞ্চেলর এঙ্গেলা মের্কেল ফ্রান্সের জনগণের প্রতি তার সমর্থনের কথা জানিয়েছেন এবং নটরডামকে ‘ফ্রান্স এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রতীক’ বলে অভিহিত করেছেন।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে এক টুইটে লিখেছেন, ‘ফ্রান্সের জনগণের সাথে এবং জরুরি পরিষেবাগুলির সাথে যারা নটরডাম ক্যাথেড্রালে ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডের বিরুদ্ধে লড়াই করছে আজ রাতে তাদের প্রতি আমার সমবেদনা’।

ভ্যাটিক্যান থেকে বলা হচ্ছে, এই অগ্নিকাণ্ডের খবর তাদের শোকাহত এবং ব্যথিত করেছে এবং তারা ফরাসি ফায়ার সার্ভিসের জন্য প্রার্থনা করছে।

একটি জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র নটরডাম ক্যাথেড্রালের পাথরে ফাটল দেখা দেয়ার পর ভবনের সংস্কার কাজ চলছিল।

অগ্নিকাণ্ডে ঘটনায় প্যারিসের প্রসিকিউটর অফিস তদন্ত শুরু করেছে।

বিডি২৪লাইভ/টিএএফ

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: