ইবিতে প্রস্তুতি ছাড়াই নতুন বিভাগ খোলায় বিড়ম্বনা!

প্রকাশিত: ১৯ আগষ্ট ২০১৮, ০৩:৪১ পিএম

স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)। প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে বিশ্ববিদ্যালয়টি নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন। প্রতিষ্ঠার তিন যুগ পেরিয়ে গেলেও বয়স অনুযায়ী বিভাগ চালু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত এসে বিভাগ সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ টি। বর্তমান প্রশাসন চলতি শিক্ষাবর্ষে আটটি নতুন বিভাগ চালু করেছে। তবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া এসব নতুন বিভাগ খোলায় বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে ওই বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অনেক বিভাগে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে টিএসসিসি’তে এবং ধার করা শিক্ষক দিয়ে। এভাবে প্রস্তুতিহীন আরো নতুন বিভাগ খোলার পরিকল্পনা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৭৭ সালের ২৭ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বিভাগ চালুর জন্য অধ্যাপক ড. এম. এ বারীকে সভাপতি করে ৭ সদস্যবিশিষ্ট পরিকল্পনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি থিওলজি অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের অধীনে আল কুরআন ওয়া উলূমূল কুরআন, উলূমূত তাওহীদ ওয়াত দাওয়াহ, আল হাদীস ওয়া উলূমূল হাদীস, আশ শরীয়াহ ওয়া উসূলুস শরীয়াহ, আল ফাল সাফাহ ওয়াততা সাউফ ওয়াল আখলাখ বিভাগ, মানবিক ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধীনে আরবি ভাষা ও সাহিত্য, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, অর্থনীতি, লোক প্রশাসন, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিভাগ ও ভাষাতত্ত্ব এবং বাণিজ্য বিভাগ এবং বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগ চালুর জন্য সুপারিশ করেন।

পরবর্তীতে ১৯৮৫-১৯৮৬ শিক্ষাবর্ষে থিওলজি অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের অধীনে আল কুরআন ওয়া উলূমূত কুরআন, উলূমূত তাওহীদ ওয়াত দাওয়াহ এবং মানবিক ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধীনে হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ চালু করা হয়। এই চার বিভাগের অধীনে তিনশত ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির। তখন ৩০০ জন ছাত্রের জন্য ৮ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ১৯৮৬ সালের ২৮ জুনে ৩ টি অনুষদের অধীনে বিভাগের সংখ্যা দাড়ায় ১৬টি।

দিনের পালাক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বিভিন্ন অনুষদের অধীনে একাধিক বিভাগ চালু করা হয়। বর্তমানে চারটি অনুষদের অধীনে ৩৩ বিভাগ চালু রয়েছে। চলতি শিক্ষাবর্ষে তিনটি অনুষদের অধীনে নতুন আটটি বিভাগ চালু করা হয়।

এর মধ্যে ফলিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুষদের অধীনে ফার্মেসী বিভাগ, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিানিয়ারিং বিভাগ, ইনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড জিওগ্রাফি বিভাগ, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের অধীনে হিউমেন রিসোর্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, মানবিক ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধীনে ডেভেভলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, সোশ্যাল ওয়েলফেরায় ও আইন ও শরীয়াহ অনুষদের অধীনে আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগ চালু করা হয়েছে।

নতুন এসব বিভাগ চালু হওয়ায় আসন সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৫৫০ টি। তবে এই শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি হয়নি কোন আবাসিক ব্যবস্থা বা একাডেমিক সুবিধা। নতুন বিভাগের ক্লাস চলছে অন্য বিভাগের ধার করা ক্লাসসহ বিভিন্ন রুমে। বিশেষ করে সায়েন্স ফ্যাকাল্টির অধীনে নতুন বিভাগগুলোর কোনটিরই নিজস্ব ল্যাব নেই। এর ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের ল্যাবের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। এক কথায় কোন প্রকার প্রস্তুতি ছাড়াই খোলা হয়েছে এসব বিভাগ।

এছাড়া নতুন বিভাগগুলোতে এবছরই ৪৯ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এসব শিক্ষকদেরও নেই কোন রুম বরাদ্দ। শিক্ষকদের জন্য আলাদা রুম বরাদ্দ না থাকায় অনেক বিভাগের শিক্ষকদেরকে বিভাগীয় সভাপতির ভিজিটর রুম বা এক রুমে একাধিক শিক্ষক ভাগাভাগি করে বসতে হচ্ছে। এর ফলে তাদের প্রাইভেসি এবং ব্যক্তিত্ত্ব নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক শিক্ষক বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য ব্যাক্তিগত কক্ষ দরকার। এতে নিজস্বতা বজায় থাকে। এর মাধ্যমে ক্লাস-পরীক্ষার প্রতি কনসেনট্রেশন বৃদ্ধি করা যায়।’

ক্লাস রুম সংকটের বিষয়ে নতন চালু হওয়া হিউম্যান রিসোর্চ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সভাতি অধ্যাপক ড. কাজী আখতার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা মার্কেটি বিভাগের কাছ থেকে একটি রুম কিছুদিনের জন্য নিয়েছি। সেখানেই মূলত এখন ক্লাস চলছে। আমাদের ফ্যাকাল্টির রুমগুলো যেহেতু ডিনের অধীনে সেজন্য আমরা ইতোমধ্যে বিভাগের আলাদা রুমের জন আবেদন করেছি। আশা করছি খুব দ্রুত আমাদের বিভাগের জন্য রুম বরাদ্দ পেয়ে যাব।’

এছাড়া শিক্ষকদের রুম সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা অবশ্য ঠিক যে প্রত্যেক শিক্ষকদের আলাদা রুম থাকা দরকার। কিন্তু বিভাগ একেবার নতুন হওয়ায় এখনও আমরা শিক্ষকদের আলাদা রুম বরাদ্দ দিতে পারেনি। এ ব্যাপারে অনুষদীয় ডিনের সাথে কথা হয়েছে। খুব শিগ্রিই নতুন শিক্ষকদের রুম বরাদ্দ হবে।’

ল্যাব সংকটের বিষয়ে নতন চালু হওয়া বায়োমেডিকেল ইঞ্জিানিয়ারিং সভাপতি অধ্যাপক ড. তপন কুমার জোদ্দারের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ‘প্রথম থেকেই আমাদের ক্লাস রুমের তেমন একটা সংকট না থাকলেও ল্যাবের সংকট ছিল। এখন প্রথম বর্ষের পরীক্ষা প্রায় শেষের দিকে। পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা রসায়ন বিভাগের একটি ল্যাব ও বায়োমেডিলের জন্য একটি ল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়েল মেডিকেল সেন্টারে করিয়েছি। বিভাগের নিজস্ব ল্যাবের ব্যপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে কথা হয়েছে। তারা আমাদেরকে আশ্বস্থ করেছেন।’

এদিকে বিভিন্ন অনুষদের অধীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আরো নতুন ৮ টি বিভাগ খোলার প্রস্তুুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) এস এম আব্দুল লতিফ বলেন, ‘নতুন আরো আটটি বিভাগ খোলার জন্য আমরা ইউজিসি’র নিকট ডিমান্ড নোট পাঠিয়েছি। তারা বিষয়টি যাচাই বাচাই করে অনুমোদন দিলে আমরা নতুন বিভাগ খুলতে পারব।’

এই অবস্থায় নতুন বিভাগ খোলা হলে আবাসিক সমস্যা ও ক্লাসরুমে সংকট প্রকট আকার ধারণ করবে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। বিষয়ে নতুন বিভাগে ভর্তি হওয়া একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বললে জানান, ক্লাস রুমের সংকট, শিক্ষক সংকটসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত আমরা। আমাদের নিদিষ্ট কোনো ক্লাস রুম নেই। অন্য বিভাগের ক্লাস রুমে আবার কখনো টিএসসিসি’র করিডরেও আমাদের ক্লাস করতে হচ্ছে। এর উপর যদি আবার নতুন বিভাগ খোলা হয় তাহলে নতুন বিভাগের শিক্ষার্থীরা আমাদের থেকেও বেশি অবহেলিত হবে।

এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার জন্যই মূলত নতুন নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সচেতন শিক্ষক মহল। তাদের দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত নিয়োগগুলোতে নিয়োগ বাণিজ্যের হিড়িক পড়ায় তারই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বলেন, ‘বিগত নিয়োগগুলোতে নিয়োগ বাণিজ্যের হিড়িক পড়ার তথ্য বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় দেখেছি। সে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য যদি নতুন বিভাগ খোলা হয় তাহলে পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় ইমেজ সংকটে পড়বে। যা কখনোই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শুভকর নয়।’

নতুন বিভাগগুলোতে উদ্ভুত সমস্যা ও যুগোপযোগী বা চাকরির বাজারে বিভাগগুলোর চাহিদা কতটুকু এ নিয়েও ভাবনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘অবকাঠামোগত প্রস্তুতি নিয়েই এসব নতুন বিভাগ খোলা উচিত ছিল। সবকিছু নিয়মতান্ত্রিক হওয়া উচিত। বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যে অবস্থা এটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাম্য হতে পারে না। আমরা চাই বিশ্ববিদালয়ের সার্বিক উন্নয়ন হোক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগোপযোগী নতুন নতুন বিভাগ চালু হোক তবে সেক্ষেত্রে অবকাঠামোগত প্রস্তুতি, শিক্ষাগত উন্নয়নের জন্য নিময়তান্ত্রিক শিক্ষক নিয়োগসহ সব কিছু ঠিকঠাক করেই।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য) অধ্যাপক ড. এম শাহিনুর রহমান বলেন, ‘একেবারে প্রস্তুতি ছাড়াই যে বিভাগুলো খোলা হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। আমাদের যে রবীন্দ্র-নজরুল কলা ভবন নির্মনাধীন রয়েছে। সেটি প্রায় শেষের দিকে। এটি হয়ে গেলে শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুম সংকট ও শিক্ষাকদের রুম বরাদ্দের সমস্যাটি সমাধান হয়ে যাবে।’

বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোর ল্যাব সংকটের বিষয়ে উপ উপাচার্য বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা আবর বিশ্ব থেকে বেশ কিছু অর্থ প্রাপ্ত হয়েছি। এই অর্থের মাধ্যমে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকলের জন্য একটি অত্যাধনিক ল্যাব প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়েছি। ইতোমধ্যে এ সম্পর্কে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এটি হয়ে গেলে আশা করি এই সমস্যাটিও আর থাকবে না। এছাড়া আমার সম্প্রতি একনেক সভা কর্তৃক পাঁচশত কোটি টাকার যে মেগা প্রজেক্টের অনুমোন পেয়েছি সেটি বাস্তবায়ন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবকাঠামোগত সমস্যাগুলো আছে তা আর থাকবে না। ’

বিডি২৪লাইভ/এমকে

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: