১২ নভেম্বরের কথা শুনলে, আজও আতঙ্কে ওঠি’

প্রকাশিত: ১২ নভেম্বর ২০১৮, ০৬:১৯ পিএম

ভোলার মনপুরা উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদ উল্লাহ। বয়স ৭০। পিতা মৃত আনোয়ার আহমেদ। মাতা মৃত জরিনা খাতুন। ৩ ছেলে ৫ মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্ককরী বন্যায় বাবা-মাসহ পরিবারের ৬ সদস্যকে হারান তিনি।

ভয়াল ১২ নভেম্বর রাতের ধ্বংসযজ্ঞের কথা আজও ভুলতে পারেননি সে। শুধু মোহাম্মদ উল্লাহ নয়, উপকূলের ধ্বংসযজ্ঞের কথা আজও ভুলতে পারেননি ভোলার উপকূলের স্বজনহারা মানুষ। উন্মুক্ত চরাঞ্চলে বসতি গড়া লাখ লাখ মানুষের জীবন এখনও চরম ঝুঁকিতে।

আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর। শতাব্দীর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সেদিন লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, সন্দ্বীপসহ উপকূলীয় বিশাল জনপদ। প্রাণহানি ঘটে ভোলার ২ লাখ মানুষের। মারা যায় লাখ লাখ গবাদিপশু ও জীবজন্তু। দেশের উপকূল এখন জুড়ে নতুন ফসল কাটার মৌসুম। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের পরিবেশও ছিল একই।

সিডর, নারগিস, আইলা, রোয়ানুর আঘাতের সংবাদ এ অঞ্চলের মানুষ আগাম জানতে পারলেও ৭০’র ‘গোর্কি’র কথা আবহাওয়া দপ্তর আগে জানাতে পারেনি। প্রকৃতির কাছে আজও অসহায় উপকূলের মানুষ। ১২ নভেম্বর অন্য উপকূলের মতো ভোলায় উপকূলেও ৮/১০ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে।

ভোলার মনপুরা উপজেলার, হাজিরহাট ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আয়েশা বেগম (৮৫) সেদিনের স্মৃতিকে মনে করে আবেগ তাড়িত হয়ে বলেন, সত্তরের গোর্কীতে চোখের সামনেই ভেসে গেছে ৩ ছেলে। কিছুই করতে পারিনি। সারারাত কোনমতে গাছ ধরে বেঁচে থাকলেও ভোর হতেই দেখি ২০ সদস্যের পরিবারের ১২ জনই ভেসে গেছে বানের পানিতে। একটি লাশও পাইনি কবর দিতে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষ আর গবাদি পশুর লাশ সৃষ্টি করেছিল এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির। সেদিন মানুষ আর পশুর লাশ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

ভয়াবহ স্মৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে একই ইউনিয়নের সফিউল্লাহ মাস্টার বলেন, সেইদিন ছিল ১০ রমজান। সন্ধ্যার পর চারিদিকে শোঁ শোঁ আওয়াজে বাতাস বইতে থাকে। হঠাৎ ভয়ঙ্কর গর্জনে আকাশ অন্ধকার করে প্রচণ্ড বেগে ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়। ওই হাওয়া আমাকে উড়িয়ে কোথায় উঠিয়ে নিয়ে গেছে বলতে পারিনি। পরদিন সূর্যোদয়ের পর আলোতে বাঁশের ঝোঁপ ধরে মাথা তুলে দেখি চারদিকে লাশের সারি। লাশ দেখে পরিবারের লোকজনের কথা কথা মনে পড়ে।

জানা যায়, ১২ নভেম্বরের এমন বীভৎস ট্র্যাজেডির কথা বিশ্ববাসী থাকুক দূরের কথা দেশবাসীও জানতেন না। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কাউকে জানায়নি।

তৎকালীন ‘দৈনিক পূর্ব দেশ’ র ভোলা প্রতিনিধি বর্তমান দৈনিক বাংলার কণ্ঠের সম্পাদক ও বাংলাদেশ বেতারের ভোলা প্রতিনিধি এম হাবিবুর রহমানের তোলা লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া এই জনপদের ছবি ও সংবাদ নিয়ে তার আত্মীয় খলিলুর রহমান ট্রলারযোগে চার দিন পর ঢাকায় পৌঁছান। ঝড়ের পঞ্চমদিন পূর্বদেশে ছাপা হলে আঁতকে ওঠে সারাদেশের মানুষসহ বিশ্ববাসী।

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ছিল জেলার তজুমদ্দিন উপজেলা। সেখানে ১৬৭০০০ জন অধিবাসীর মধ্যে ৭৭০০০ জনই (৪৬%) প্রাণ হারায়। প্রতি বছর এ দিনটি স্মরণে উপকূলীয় চরাঞ্চলে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে শোকাবহ এ দিবসটি পালন করে।

বিডি২৪লাইভ/এমকে

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: