‘আজকাল হিরো-হিরোইনরাই সব, আমরা তো চিড়িয়াখানার বান্দর’
‘আমাদের অনেক সমস্যা। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সাধ আছে কিন্তু সাধ্য নেই। অনেক কিছুই করার ইচ্ছে করে কিন্তু সাধ্যের অভাবে পারি না। আমরা মানুষকে বিনোদন দেই অথচ মানুষ আমাদের দেখলেই ওপেনলি মজা নেয়। কিন্তু আমরা কি সেই মজার লোক? মানুষ ভাবে আমরা চিড়িয়াখানার বান্দর। পারলে একটু ঢিল মারতে চায়। এরকম আমি অনেক পড়ছি অনেক দেখছি। সিনিয়র নাই জুনিয়র নাই, বড় ছোট নাই সবাই এমন করে। আমি যেটা জানি এবং মানি সেটা হচ্ছে শিল্পীদের কখনো উচ্চস্বরে কথা বলতে নেই। কিন্তু শুটিং সেটে কার কী ক্ষমতা সেটা দেখানোর চেঁচামেচি সবসময়ই চলে। ভালো হতো সেটা যদি অভিনয় দক্ষতা বা যোগ্যতা দেখানোর জন্য হতো। আমার তো সাধারণত অভিনয় শেখা নাই, দেখে দেখে শেখা আর কি। সেই অর্থে আমি থিয়েটার কি বুঝি না। যখন বুঝলাম তখন যারা থিয়েটার করা মানুষ তাদের দেখলে নত হয়ে যাই। তাদের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করি। কখনো গোপনে, কখনো বা প্রকাশ্যে। আমি যখন একটি কাজে অংশ নেই তখন এটা মনে করি যে আমার উপর ওই কাজের ডিরেক্টর, প্রডিউসারের সম্মান নির্ভর করছে। বাজে অভিনয় করলে আমার তো হবেই, তাদেরও বদনাম হবে। আমি কাজ পাবো না সেটা একক সমস্যা। কিন্তু একজন নির্মাতা বা প্রযোজক আমার জন্য ভোগান্তিতে পড়লে সেটা কিন্তু অনেককে প্রভাবিত করে। তাই সচেতন থাকি। রোগ বালাই যাই হোক, ক্যামেরার সামনে থাকলে নিজে যা জানি তার সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করি’- এভাবেই বলছিলেন অভিনেতা শামীম আহমেদ। তার আসল নাম শামীম হোসেন হলেও অনেকেই তাকে শামীম আহমেদ নামেই চেনেন বা জানেন। ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে এক হাজারেরও বেশি নাটক এবং ২৬টিরও বেশি সিনেমায় কাজ করেছেন এ অভিনেতা। নাটক কিংবা সিনেমাতে তাকে কমেডিয়ান চরিত্রেই বেশি দেখা যায়। বিডি২৪লাইভের বিনোদন বিভাগের সঙ্গে নিজের ক্যারিয়ার, পেছনের গল্প নিয়ে কথা বলেন কমেডিয়ান এই অভিনেতা।
ক্যারিয়ার শুরুর দিক নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ১৯৮৬ সালের দিকে মহিলা সমিতি অফিসের পিওন ছিলাম। সেখানে ক্যান্টিনে থাকতাম। আর অভিনয়টা আসলে আমি শিখি হুমায়ূন ফরিদী ভাইকে দেখে দেখে। অভিনয় করার ইচ্ছা আমার কখনোই ছিলো না। করার আগ্রহও জাগে নাই তখন। কিন্তু দেখার আগ্রহ ছিল অনেক। তাই তখন উনার অভিনয় মন ভরে দেখতাম। পরে যখন অভিনেতা হলাম উনার অভিনয় আমাকে প্রভাবিত করলো। আমি শিষ্য হলে উনারই হতাম। অভিনয়ে আরেকজন ম্যাজিশিয়ান আছে আমাদের। এটিএম শামসুজ্জামান। আমার খুব প্রিয় নানা। তার কথা যদি বলি তবে মন খারাপ হয়ে আসে। প্রায় ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এই লাইনে। কী না করেছেন। অভিনয়, লেখা, পরিচালনা, প্রযোজনা। কী তার মন-মানসিকতা। বিরাট বটবৃক্ষ। এই লোকটা ২০-৩০ হাজার টাকা পায় এখন নাটকে। সেটাও কতো কাহিনি করে। এই দেশে অভিজ্ঞতার দাম নেই। গ্ল্যামার আর নায়ক-নায়িকা হওয়াটাই বড় কথা। নইলে যেখোনে নতুন একটা ছেলেমেয়ে হুট করেই এসেই দিনে ৩০ করে পারিশ্রমিক নেয় সেখানে ষাট বছর ধরে অভিনয় করা একজন মানুষের পারিশ্রমিক তার চেয়ে কম কী করে হয়! তার নাম নিলেই তো ৫০ বলা উচিত। এসব সিস্টেম নেই বলেই এই দেশে নাটকের মান বাড়ে না। তবে আমার মন খারাপ হলেও একটা বিষয় ভেবে শান্তি পাই। যারা দিতে পারে আর নিতে পারে এটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু আমরা কম খাবো, বেশি দিন বাঁচবো। বেশি খাওয়ার জন্য ঠাস করে পড়ে যাবো না। ১৭ বছরে গ্ল্যামার কম দেখলাম না। অনেককে আজকাল দূরবীন দিয়েও মিডিয়াতে দেখা যায় না। আমি ছোট মানুষ, করে খাচ্ছি এখনো।’
শামীম আহমেদের অভিনয়ের পথচলার শুরু ১৯৯৯ সালে ‘বন্ধন’ ধারাবাহিক নাটকের মাধ্যমে। শামীমের ভাষায়, ‘বন্ধন নাটকের প্রোডাকশন ম্যানেজার ছিলাম আমি। শামীমা আপা ছিলেন পরিচালক। আমার একটা সবচেয়ে বড় গুণ ছিলো, কোন কোন আর্টিস্ট কখন ওষুধ খাবে, কোন আর্টিস্ট কখন ডায়াবেটিসের ইনসুলিন নেবে আর নেওয়ার কতক্ষণ পর সে খাবে, কোন নায়ক কখন খাবে এই বিষয়গুলো মনে রাখতে পারতাম। আর কাজটা ঠিকমত করতাম। আমি খুব পরিছন্ন ছিলাম। ওই নাটকে আফসানা মিমি আপা ছিলেন। এই নাটকে একটা চরিত্র ছিল ‘লোকমান’। লোকমান চরিত্রটা করার জন্য যে ছেলেটাকে সিলেক্ট করা হয়েছিলো দুইদিন শুট করার পর সে আর আসেনি। কারণ তার কী একটা পরীক্ষা চলছিল। দুইদিনে ওই চরিত্রের তেমন কিছু করা হয়নি। ওই সময় উচ্ছ্বাস, সোহান ওরা মামুনূর রশীদ স্যারের অন্য নাটকে শুটিং করছিলো। পনের দিনের মধ্যে ফ্রি হতে পারবে না। ঠেকার কাজটা চালানোর জন্য হইলেও চরিত্রটা দাঁড় করাতে হবে এমন অবস্থা। তখন সেদিন রাতে মিমি আপা, পান্থ ভাই, অম্লান বিশ্বাস, অমিতাভ ভাই, মুরাদ ভাই এরা ছিলেন একসঙ্গে। হঠাৎ মিমি আপা আমাকে ডেকে বলল, শামীম তুই লোকমান ক্যারেক্টারটা পড়ছস? আমি কইছি, হ পড়ছি। অথচ কিচ্ছুই পড়ি নাই। দুষ্টামি করে বলছিলাম। কারণ, তারা জানেন যে আমি নিয়মিতই স্ক্রিপ্ট পড়ি। নিজেরও পড়িনি বলে লজ্জা পাবো তাই বললাম পড়েছি।
মিমি আপা জানতে চাইলেন, ‘কি পড়ছস? আমি কইলাম, ওই যে যা পড়ছি, তাই পড়ছি। তখন আপা কইল, তুই এই দুইটা সিন পড়ে রাখ, এই দুইটা তুই করবি। আমি কইলাম মাথা খারাপ! আমি অভিনয় করমু? আমি অনেক অনেক বড় অভিনেতা চোখের সামনে দেখেছি। উনাদের দেখে দেখে একটা জিনিস বুঝেছিলাম অভিনয় জিনিসটা আসলে এত সহজ না। উপরওয়ালা যদি স্বয়ং নিজে হাত না দেয় তাহলে কখনো সম্ভব না। তাই ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু সবাই অনেক বলার পর, সাহস দেয়ার পর চরিত্রটা আমি করি। আমার প্রথম দৃশ্যটা এক টেকে ওকে হয়ে গিয়েছিলো। এরপর এভাবে ২০ পর্ব পর্যন্ত আমরা শেষ করি। বাকিটুকু ইতিহাস।’ কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে শামীম স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘ওই নাটকটা করতে গিয়ে আমার বড় অভিজ্ঞতা হল যে, নাটক দেইখাও যে পুরস্কার পাওয়া যায় জানলাম। মাছরাঙা প্রোডাকশন হাউজের মালিক অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু স্যার আমাকে ২০ হাজার টাকা দিলেন। এরপর তুষার ভাই দিলেন আরও ৫ হাজার টাকা শুধুমাত্র একটা দৃশ্য করার জন্য। এরপরও আমি আর আর অভিনয় করব না জানিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পিন্টু স্যারের কথায় আবারো শুরু করি এবং তারপর থেকেই নিয়মিত। আসলে আমার ভাগ্য এখানে ছিলো।’
শামীম বলে যান, ‘মানুষ পিছনের কথা বলে না কখনো। আমি সবসময় সত্যবাদী। পিন্টু স্যার একবার আমাকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন আমার সত্যবাদীতার জন্য। কারণ একদিন আমি আমার ইতিহাস জানাতে গিয়ে উনাকে বলেছিলাম যে আমি পকেটমার ছিলাম, রিক্সা চালাইছি শহরে শহরে। আমি অভাবী ঘরের মানুষ। অভাব ছিলো। সঙ্গদোষে নানা পথে গিয়েছি। মূল কথা হলো আমি সব মন্দা কাটিয়ে নিজেকে একটা ভালো পথে চালিত করতে পেরেছি। পরিশ্রম করে, নিজের মেধা ও সৃষ্টিশীলতা দেখিয়ে হালাল পয়সায় বেঁচে আছি। এটা আমাকে শান্তি দেয় খুব। লুকিয়ে রাখলে রাখতে পারাতাম। চাপে মেরে বলতে পারতাম আমার বাবা জমিদার ছিল। আমি দেখেছি সত্য শুনে মানুষ অবাক হলেও সেটাকে সবাই খুব সহজে গ্রহণ করে ও মেনে নেয়। সম্মান করে সত্যকে।’
সিনিয়রদের সঙ্গে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা জানিয়ে এই অভিনেতা বলেন, ‘অনেক সিনিয়রদের সাথে যখন অভিনয় করি তখন আমার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। একবার মামুনুর রশীদ স্যারের সাথে আমার একটা সিন ছিল। উনাকে দেখে আমার শরীর কাঁপা শুরু করে দিল। তখন স্যার বললো কিরে তর শরীর কাঁপে কেন? আমি কইলাম, আপনার সাথে অভিনয় করমু তো, কাঁপবো না! তখন আমাকে বলল, মনে কর তর শত্রু তর সামনে বন্দুক তাক করছে, তুইও করছস। তখন কি তুই বন্দুক ছেড়ে দিবি? আমি কইলাম, না! তখন বলল, তাহলে ওইটাই কর। বন্ধুক চালা। এই বন্ধুক অভিনয়ের। এভাবেই প্রত্যেকটা সিনিয়র মানুষ আমাকে কাজের জায়গা থেকে সহযোগিতা করেছেন।’
শামীম আহমেদ এক হাজারেরও বেশি নাটকে কাজ করেছেন। প্রায় ২৬টা চলচ্চিত্রেও দেখা গেছে তাকে। তার প্রথম সিনেমা ছিল ‘জীবন মরণের সাথী’। শাকিব খানের বন্ধু চরিত্রে কাজ করেছিলেন। এরপর একে একে শাকিবের সঙ্গে আরও অনেক ছবিতে কাজ করেছেন। শাকিব খানে সঙ্গে অভিনয়ের অভিজ্ঞতায় শামীম বলেন, ‘শাকিব খানের সাথে অনেক ছবি আমি ছেড়ে দিছি। ‘মাই নেইম ইজ সুলতান’ ছবির জন্য আমি ২৫ দিন শিডিউল দিয়েছি। দেখা গেলো আমার শিডিউল নিলো ভালো কথা আজ শাকিব অসুস্থ, কাল মাথা ব্যাথা, পরশু আসতে দেরি হলো এই করতে করতে চলে যায়। আজকাল করে শিডিউল নিয়ে ঠিকমত কাজটা হয় না। পরিচালক ফোন দিয়ে বলে আজ তো হচ্ছে না, কাল আসো। কোনো প্রশ্ন আর করতে পারি না। করলে বলে, বোঝোই তো হিরো। এটাতেও শাকিবের বন্ধু চরিত্র ছিল। এর জন্য নিজেকে প্রস্তুতও করেছিলাম। কিন্তু হলো না। তৃপ্তির জায়গাটা পেলাম না। এ কারণে শাকিব খানের সাথে আমি ছবি এখন আর করি না। আজ ব্যাংকক, কাল মালয়েশিয়া, আজ ঢাকা তো সেটে আসবে ৩টার পর। এভাবে করে তো কাজ করা যায় না। আমি গরীব মানুষ। আমাকে কাজ করতে হয় নিয়মিত। অন্যের শিডিউলের উপর জীবন আমার চলবে কেমন করে।’ ছোট শিল্পী হিসেবে মূল্যায়িত হয়ে নানা আক্ষেপের কথা জানান শামীম।
তিনি বলেন, ‘আমার মতো আরও অনেকেই আছেন যাদেরকে পরিচালকরা একটু দুর্বল চোখে দেখেন। পরিচালকদের বলি ভাই, আমাদের ডেটের বিষয়টা ১৫-২০ দিন আগে জানায়েন। আসলে আমারা তো আর নায়ক না, তাই পরিচালকরা আমাদের এতটা গুরুত্ব দেয় না। মনে করে যখন খুশি চাইলেই ডেট পাওয়া যাবে। এমন করে কত ডেট যে খেলো কতজন ঠিক নাই। তারপর আমাদের টাকা দিতে গিয়েও তাদের কত সমস্যা। টাকা চাইলেই বলে, তোমরা তো নিজেদের লোক পেয়ে যাবা। অথচ নিজেদের লোক হলে তো আগে পাওয়ার কথা। কিন্তু তার আর খবর থাকে না। বলতে থাকি, ভাই আমাদেরও তো পরিবার আছে, বউ বাচ্চা আছে। অভিনয় করেই তো খাই। অন্যকিছু তো করি না। তাহলে আমাদের সাথেই কেন এমন করা হবে।
শুটিং শেষ করে যখন অনেক রাতে বাড়ি ফিরি মাঝপথে ছিনতাইকারী ধরলেও কিছু বলতে পারি না। পরিবারের চিন্তাটাতো আছে। অরা কিছু বলার আগেই আমি বলি, ভাই যা আছে সব নিয়ে যান, আমি দিয়ে দিচ্ছি কোনো টেনশন নিয়েন না। কিন্তু কেন এটা করি! আমার কিছু হয়ে গেলে আমার পরিবারের কি হবে। কিছুদিন আগেই এমনটা হল, আমার মোবাইলসহ অনেক কিছুই নিয়ে গেল। নিজে সুস্থ আছি এটাই শুক্কুর আলহামদুলিল্লাহ।’
বিডি২৪লাইভ/আইএন/আরআই
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]
পাঠকের মন্তব্য: