হাতিরঝিল, মধ্যরাত, প্রেম এবং...

প্রকাশিত: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:১০ পিএম

ঢাকা। একটি মেগাশহর। মানুষ আর মানুষ। চারদিকে কোলাহল। মুখরিত নগরী। প্রতি মুহূর্তে ঢাকায় পা দিচ্ছে গ্রাম থেকে আসা অসংখ্য মানুষ। তাদের অনেকেই ঢাকায় নতুন। বুড়িগঙ্গা তীরের ৩০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই শহরে প্রতিনিয়ত বাড়ছে মানুষের চাপ।

সড়কে তীব্র যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা থেমে থাকে গাড়ি। দিনের কর্মব্যস্ত শহর রাতে পাল্টে যায়। দিনে ও রাতে অভিন্ন ঢাকা ধারণ করে ভিন্ন রূপ। শহরের রাতের রূপটি আকৃষ্ট করে অনেককেই। একইভাবে সুবিধাবঞ্চিতদের রাত্রি যাপন কষ্টও দেয়। সবমিলিয়ে এ এক আজব শহর।

রাত ১১টার পর থেকেই রাস্তা ফাঁকা হতে থাকে। থেমে যায় ব্যস্ত নগরীর কোলাহল। কোনো কোনো অলিগলিতে ভর করে নির্জনতা। সড়কজুড়ে তখন লাল, নীল আলোর খেলা। মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আলো ছড়িয়ে দেয় লাইটপোস্টগুলো। নিস্তব্ধ রাতে পুলিশ, জরুরি প্রয়োজনে বাইরে থাকা পথচারী, বিভিন্ন শপিংমলের নিরাপত্তাকর্মী, সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, ছিনতাইকারী, ভাসমান নারী, কুলি, সিএনজি অটোরিকশা ও রিকশাচালক, মজুর আর বেওয়ারিশ কুকুর মিলেমিশে সৃষ্টি হয় অন্য রকম এক দৃশ্যের।

এছাড়াও রাতের শহরে গণমাধ্যমকর্মীদের দেখা মেলে। দূর থেকে গাড়ির হেডলাইটের আলো এসে পড়লে খুব ঠুনকো জিনিসকেও অনেক বড় মনে হয়। যানজটহীন সড়কে বাড়ে যানবাহনগুলোর গতি। কেউ কেউ উচ্চ শব্দে মিউজিক বাজিয়ে ড্রাইভ করেন বিলাসী গাড়ি। যানজটে যারা দিনের বেলাতে বাইরে বের হতে চান না তাদের অনেকেই বেছে নেন রাতের ঢাকা।

উত্তরার বাসিন্দা আমজাদ হোসেন চৌধুরী জানান, ঢাকায় বাসা হলেও পেশাগত কারণে তিনি থাকেন ঢাকার বাইরে। ঢাকায় এলে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া দিনের বেলা বের হন না। আত্মীয়স্বজনের বাসায় বেড়াতে গেলে বেছে নেন রাতের সময়কে। রাত ১১টার পরে গাড়ি নিয়ে বের হন। তখন যানজটহীন শহরে অল্প সময়ে শহরের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে যাওয়া যায়।

রাতের শহরে আড্ডা জমে হাতিরঝিলে। সাধারণত রাত ৯টার পর থেকে কর্মজীবীরা ভিড় করেন সেখানে। বিলাসী মোটরসাইকেল, কারযোগে হাতিরঝিলে যান তারা। রামপুরা, মহানগর ও মধুবাগ ব্রিজে দাঁড়িয়ে-বসে আড্ডা। চিপস, বাদাম খান। হাতিরঝিলের রেস্টুরেন্টগুলো রাত ১০টায় বন্ধ। যে কারণে ফেরিওয়ালাদের চা, কফিতেই ভরসা তাদের। কেউ কেউ সিগারেটে সুখটান দেন। কোরাস কণ্ঠে গান করেন। সাধারণত রাতের আড্ডায় বন্ধু-বান্ধবী ও প্রেমিক-প্রেমিকাদের অংশগ্রহণই থাকে বেশি।

শীতের তীব্রতা উপেক্ষা করেই ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়ান তারা। কোনো কোনো জুটি আধো আলো-আঁধারে বসে, দাঁড়িয়ে রেলিংয়ে হাত রেখে গল্প করেন। ব্রিজের নিচের ঝিলের জলে তাকিয়ে কাব্য করেন। ঘটে ব্যতিক্রম ঘটনাও। গত শনিবার রাত সাড়ে ১২টা। মধুবাগ ব্রিজে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন চার জন। দুই তরুণ, দুই তরুণী। তিনটি মোটরসাইকেলে গুলশান থেকে এসেছেন তারা।

প্রেমিকার প্রতি সন্দেহমূলক প্রশ্ন প্রেমিকের, গতকাল  দুপুরে কার সঙ্গে লাঞ্চ করেছেন তরুণী। সহকর্মীর সঙ্গে এতো ভাব কেন? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। তরুণী এসব প্রশ্নে ক্ষুব্ধ। অনেকটা চিৎকার করে তার সোজা সাপ্টা জবাব, বিশ্বাস যেখানে নেই, সেখানে ভালোবাসা থাকতে পারে না।

আশেপাশের অনেকের দৃষ্টি তখন এই জুটির দিকে। প্রেমিক ছেলেটিও রেগে যায়। ঘটায় পাগলামো কাণ্ড। নাইটরাইডার বাইকটির পিকাপ বাড়িয়ে দ্রত চলে যায় বেগুনবাড়ি সংলগ্ন হাতিরঝিলের সড়কে। স্বেচ্ছায় গুলশানগামী একটি গাড়ির মুখোমুখি হয় বাইকটি নিয়ে। গাড়ির ধাক্কায় সড়কের এক পাশে ছিটকে পড়ে। রক্তাক্ত হয়। গাড়ির চালকের সাবধানতার কারণে বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা হয়। প্রেমিকাসহ সঙ্গীরা দ্রুত ছুটে যায় তার কাছে। আশেপাশের লোকজন ক্ষুব্ধ হন। পুলিশ ডাকতে উদ্যত হন। এর মধ্যেই দ্রুত এলাকা ছাড়ে তারা।

হাতিরঝিল ঘুরে দেখা গেছে, পুরো এলাকাজুড়েই রয়েছে পুলিশ ও হাতিরঝিলের নিরাপত্তাকর্মীদের টহল। রামপুরা ব্রিজ, রামপুরা ইসলাম টাওয়ার সংলগ্ন প্রবেশপথ, মগবাজার ব্রিজ, হাতিরঝিলের বেগুনবাড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রয়েছে পুলিশের চেকপোস্ট। সন্দেহ হলেই চেক পোস্টে থামিয়ে চেক করছে পুলিশ। মেগাসিটির ব্যস্ততম এলাকাগুলো যখন জনশূন্য তখনও ব্যস্ততা শেষ হয় না সদরঘাট, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড ও বিমানবন্দর এলাকার। দেশের সবচেয়ে বড় কাঁচামালের হাট কাওরানবাজার, সদরঘাট, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, কমলাপুর, মতিঝিল, ফকিরাপুল, ফার্মগেট, মহাখালী, গাবতলী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগ তখন থাকে সরব।

দিনের চেয়ে রাতেই ব্যস্ততা বেশি কাওরানবাজারে। রাত ১০টার পর থেকেই এখানে আসতে থাকে কাঁচামাল ভরা ট্রাক, পিকআপ। ট্রাক-পিকাপে দখল করে মূল সড়কের একটি লেন। ট্রাক দেখলেই প্রতিযোগিতায় নামেন শ্রমিকরা। ভ্যান নিয়ে দ্রুত ট্রাকের চারপাশ ঘিরে রাখেন। ট্রাক থেকে পণ্য নামালেই টাকা পাবেন তারা। এমনকি পণ্য কেনার জন্য বেপারীরাও আটক করেন ট্রাক। উড়া হাতে শ্রমিকরাও ভিড় করেন বিভিন্ন আড়তে। এরমধ্যেই একদল কিশোর ও নারীরা চালক এবং শ্রমিককে ফাঁকি দিয়ে ট্রাক থেকে নিয়ে যান সবজি। এমনকি চিল ছোবলের মতো মোরগ নিয়ে যেতেও দেখা যায় তাদের। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত আশপাশের রেস্টুরেন্ট ও চা-রুটির দোকানগুলো বেশ ব্যস্ত। তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না সেখানে। কাওরানবাজারের ক্ষুদে ব্যবসায়ী সোহাগ জানান, দিনের তুলনায় রাতে কয়েকগুণ বেশি বিক্রি হয় এখানে।

পাশেই পাঁচ তারকা প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও। বিভিন্ন অনুষ্ঠান শেষে এখান থেকে বের হন সাহেব-বিবিগণ। নাচ-গানে অংশ নেয়া সুন্দরীদেরও দেখা মেলে এখানে। তাদের জন্য হোটেলের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ি, সিএনজি অটোরিকশা। রাতের শহরে ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা থাকে খুব কম। সড়কে নিয়ম-কানুন মানেন না ট্রাকের চালকরা। কাওরানবাজারের ভিড় নীরবেই সহ্য করেন রাতের শহরের যাত্রীরা। ফার্মগেট, পান্থকুঞ্জ, প্রেস ক্লাব মোড়, বিজয় সরণি, মহাখালী, এফডিসি এলাকায় দেখা যায় ভাসমান নিশিকন্যাদের। পুলিশের বাজির আওয়াজ পেলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। আবার ফিরে আসেন। এ যেন চোর পুলিশ খেলা। রাতে জমে মাজার পার্টি। ঢাকার মাজারগুলোতে রাতে ভিড় করেন ভক্ত-অনুরাগীরা। প্রতি বৃহস্পতিবারে ওরশ হয় শাহআলী (র.) মাজারে। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী-পুরুষরা অংশ নেন এতে।

শাহবাগ থেকে প্রেস ক্লাব, হাইকোট মাজার, গোলাপশাহ মাজার, মতিঝিল, খিলগাঁও, ফকিরাপুল, কমলাপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ফুটপাথে, স্টেশনে, অফিসের বারান্দায় রাত্রি যাপন করেন হাজার হাজার মানুষ। তারা সুবিধাবঞ্চিত। কাঁথা, চটের বস্তা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকেন তারা। এক কোটি ৫০ লাখ জনসংখ্যার এই শহরে তাদের কোনো ঘর নেই। পলিথিন বা মশারি দিয়ে নিজেদের ঘরের মতো করে তৈরি করেন অনেকে। জনসংখ্যার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম শহর ও বিশ্বের নবম বৃহত্তম শহর ঢাকা। এই শহরে প্রতি বর্গমাইল এলাকায় ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষ বাস করেন। বৈচিত্র্যময় শহরের বৈচিত্র্যময় মানুষ। সূত্র: মানবজমিন।

বিডি২৪লাইভ/এআইআর

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: