খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ‘সফলতা এবং ভুলগুলো’

প্রকাশিত: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৭:৪৪ পিএম

১৯৮১ সালের মে মাসে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে যখন হত্যা করা হয়, খালেদা জিয়া তখন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। রাজনীতি নিয়ে চিন্তাধারা তো দূরের কথা, রাজনৈতিক কোনো অনুষ্ঠানেও তাকে খুব একটা দেখা যেতো না। প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। 

এক পর্যায়ে মি. সাত্তারকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। একদিকে দলীয় কোন্দল, অন্যদিকে বিএনপির অনেক নেতার এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগদান- এই দুই পরিস্থিতিতে বিএনপি তখন অনেকটা ছত্রভঙ্গ, বিপর্যস্ত এবং দিশাহারা। 

দল টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে তৎকালীন বিএনপির সিনিয়র কিছু নেতার পরামর্শ এবং অনুরোধে ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে রাজনীতিতে আসেন খালেদা জিয়া। বিএনপি নিয়ে গবেষণাধর্মী বই লিখেছেন মহিউদ্দিন আহমদ- তার মতে, সেই সময় থেকেই খালেদা জিয়া হয়ে উঠেন বিএনপির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে থেকে দল তৈরি করেছেন।

কিন্তু পরবর্তীতে খালেদা জিয়া সে দলকে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে নেন। মি. আহমদ বলেন, ‘সেভাবে এটি রাজনৈতিক দল ছিল না, যেভাবে রাজনৈতিক দল তৈরি হয় আমাদের দেশে। বিএনপির রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠা এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। 

আজকে আমরা যে বিএনপি দেখি, যদিও সেটার আইকন জিয়াউর রহমান কিন্তু দলটাকে এ পর্যায়ে এনেছেন খালেদা জিয়া। সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময় রাস্তায় বেশ সক্রিয় ছিলেন খালেদা জিয়া। ওই আন্দোলন দেশব্যাপী তার ব্যাপক পরিচিতিও গড়ে তুলেছিল। 

জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিএনপি জয়লাভ করে। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হলেন খালেদা জিয়া। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময় তাকে কয়েকবার আটক করা হলেও আন্দোলন থেকে সরে যাননি বিএনপি চেয়ারপারসন। ওই সময় খালেদা জিয়াকে বেশ কাছ থেকে দেখেছেন  বিএনপির বর্তমান ভাইস-চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান। 

‘তিনি সব সময় যেটা বলতেন সেটা করতেন... কখনো ওনাকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে দেখিনি,’ 
বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সেলিমা রহমান। 

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ‘সফলতা এবং ভুলগুলো’

১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বিএনপির অধীনে একটি বিতর্কিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে খুব অল্প সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঘটনা বাদ দিলে খালেদা জিয়া পূর্ণ মেয়াদে সরকার পরিচালনা করেছেন দুই বার। প্রথমবার যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন দেশ পরিচালনায় তিনি ছিলেন একেবারেই অনভিজ্ঞ। 

এমনকি সংসদেও তিনি ছিলেন নতুন। কিন্তু জীবনের প্রথম নির্বাচনেই খালেদা জিয়া পাঁচটি আসন থেকে লড়ে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেন। তার রাজনৈতিক জীবনে যতগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তার কোনটিতেই পরাজিত হননি তিনি। খালেদা জিয়ার শাসন আমল, ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-২০০৬- এই দুইভাগে ভাগ করেন অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক। 
আমেরিকার পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের শিক্ষক ড. সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলেন, খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে দুর্নীতি তেমন একটা বিস্তার লাভ করেনি। 

এছাড়া, ওই সময় তিনি নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। মি. আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে অত্যন্ত রক্ষণশীল একটি রাষ্ট্র। সেই রক্ষণশীল রাষ্ট্রে তিনি প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। নারীদের ঘিরে যে কিছু প্রচলিত সংস্কার ছিল, সে সংস্কারের ব্যারিয়ারগুলো উনি ভেঙে ফেলেছেন। বাংলাদেশের নারীর অগ্রযাত্রায় ওনার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে বলে আমার সবসময় মনে হয়।’

কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হবার পর প্রগতিশীল ধারা থেকে দলটি সরে আসে বলে তিনি মনে করেন। ‘ওনাকে যেন ক্রমশই আপস করতে দেখা গেছে ধর্ম-ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অতিমাত্রায় যোগাযোগ এবং আপসের ফলে আন্তর্জাতিক যে মহল- প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য- এ দুই জায়গা থেকে তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন,’ বলছিলেন মি. আহমেদ। 

২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল এবং নির্বাচনের পর জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়েই সরকার গঠন করে। 

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির শাসনামলে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে অনেকের ধারণা। 

বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও দলের ভেতরে নানা টানাপড়েন সপষ্ট হয়ে উঠে। সমপ্রতি খালেদা জিয়ার জীবন কাহিনী নিয়ে বই প্রকাশ করেছেন সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ। তিনি মনে করেন, গণতন্ত্রের প্রতি খালেদা জিয়ার অবিচল আস্থা ছিল এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে তার ক্যারিশমা রয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের ভুলগুলো কী?- এমন প্রশ্নে মাহফুজ উল্লাহ বলেন, ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলেছিল তখন খালেদা জিয়ার উচিত ছিল সংসদ ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচন দেয়া।

এতে করে বিএনপি আরো বেশি জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসতো বলে তিনি মনে করেন। মাহফুজ উল্লাহর দৃষ্টিতে ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সরকারের কিছু দুর্বলতা ছিল। 

তিনি বলেন, ‘এই সময়টিতে কিছু কিছু দুষ্টু লোক শাসন পদ্ধতিতে ঢুকে কিছু কিছু কাজকর্ম করেছে যেটার দায় গিয়ে তার ওপর পড়েছে। বিষয়টা তাই হয়। সে সময় যদি তিনি সরকারকে সুশাসনের পথে আরো আনতে পারতেন দৃঢ়তার সঙ্গে, তাহলে পরবর্তী পর্যায়ে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলো  ঐভাবে ঘটতো না।’ অন্য অনেক রাজনীতিবিদের মতো খালেদা জিয়ার সফলতা বা অবদান যেমন রয়েছে, তেমনি তিনি বিতর্ক বা ভুলের ঊর্ধ্বে নন বলে মনে করেন অনেক পর্যবেক্ষক। তবে এমন কিছু ভুল তিনি করেছিলেন যেগুলোর মাশুল তার দল বিএনপি এখনো দিচ্ছে- অনেকের ধারণা। 

তবে খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় ভুলগুলো, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যেও মতভেদ আছে। 

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তারেক রহমানকে অতি দ্রুততার সঙ্গে দলের শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে আসা এবং ২১শে অগাস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার বিষয়টি বিএনপির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। 

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় দলের সিনিয়র অনেক নেতার সঙ্গে খালেদা জিয়ার দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। তারই একটি ফলাফল হিসেবে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে। 
ক্ষমতার মেয়াদের একেবারে শেষের দিকে দল ছেড়ে গিয়েছিলেন অলি আহমদ, যিনি এক সময় খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আনার জন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। 

এছাড়া ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হবার আগে মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। 

খালেদা জিয়া যখন রাজনৈতিকভাবে নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছিলেন, ওই একই সময়ে তার পারিবারিক ট্র্যাজেডিও ঘটে ২০১৫ সালে ছোট ছেলে আরাফাত রহমানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে অনেকটা চাপে পড়ে যায়। 
খালেদা জিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয় তার বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির মামলা। 
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে গত এক বছর ধরে তিনি কারাগারে। 

তার কারাবাস এতটা দীর্ঘ হবে সেটি অনেকেই ভাবেননি। দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ৭৩ বছর বয়সী খালেদা জিয়ার শরীরও ভালো যাচ্ছে না। 

খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বিএনপি। 

বিএনপি নেত্রীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকে নানা রকম সমীকরণ করছেন। তবে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটি নিয়ে এখনই কোনো উপসংহারে পৌঁছতে চান না সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ। 

‘১৯৭৫ সালের পর আওয়ামী লীগ আজকের বিএনপির তুলনায় কম বিপর্যস্ত ছিল না। বিএনপির দু’জন নেতা (খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান) আজকে প্রকাশ্যে অনুপস্থিত। এছাড়া গত আট-দশ বছরে বিএনপির মধ্যে কি কোনো ভাঙন হয়েছে? বিএনপি থেকে কি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ অন্য দলে চলে গেছেন? কাজেই আমি বেগম জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব শঙ্কিত নই,’ বলছিলেন মাহফুজ উল্লাহ। 

তবে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে- সেটি এখন বেশ অনিশ্চয়তায় রয়েছে বলে মনে করেন সাঈদ ইফতেখার আহমেদ। 

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এই শিক্ষক এই মুহূর্তে খালেদা জিয়ার ‘খুব ভালো কোন’ রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন না। কারণ তাকে মুক্ত করার জন্য বিএনপির তরফ থেকে কোনো কার্যকর রাজনৈতিক চাপ বা আন্দোলন দেখেননি মি. আহমেদ। 

সাঈদ ইফতেখার আহমেদ মনে করেন, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে তার অনেকটাই নির্ভর করছে বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে সংগঠিত হয়ে সরকারের ওপর কতটা চাপ তৈরি করতে পারবে তার ওপর। 
খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে যদি বিএনপি কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে, সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই বলে উল্লেখ করেন মি. আহমেদ। তথ্য সূত্র- মানবজমিন

বিডি২৪লাইভ/এএস

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: