সন্তানের আত্মহত্যার জন্য দায়ী আপনি নিজে নন তো

প্রকাশিত: ০৩ মার্চ ২০১৯, ১১:৫৮ এএম

সাম্প্রতিককালে উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের আত্মহত্যা প্রবণতা এবং তাদের বকে যাওয়া সহ বিভিন্ন ধরনের অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনা মিডিয়া পাড়ায় বেশ ঘুরপাক খাচ্ছে। এটা সত্যি অনেক ভাবার বিষয়। তবে এ জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাইরের থেকে ঘরের মানুষই বেশি দায়ী বলে আমার মনে হয়। এখনকার বেশিরভাগ বাবা-মা’ই তাদের সন্তানের পছন্দ অপছন্দের গুরুত্ব দিতে জানে না। সন্তান নিয়ে এরা এতটাই উদ্বিগ্ন থাকে সবসময় যে, অনেক সময় নিজেই দিশেহারা হয়ে যায় কি করছে সেটা ভেবে।

10th November 2015 এ ‘Journal Child psychiatry and Human Development’ নামক জার্নালে নতুন একটা গবেষণা প্রকাশিত হয় যেখানে বলা হয়, ‘Overprotective বাবা মা দের সন্তানরা বেশি উদ্বেগ ও হতাশায় ভোগে।’ এসব বাবা-মায়েরা সন্তানের হতাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।

অনেক সময় দেখা যায়, একটি শিশু সবুজ রং ভালোবাসে, আরেকটি শিশু ভালোবাসে সাদা রং। কোন ড্রেস কিংবা সন্তানের প্রয়োজনীয় কিছু কেনার সময় ওর পছন্দের সবুজ কিংবা সাদা রং বাদ দিয়ে তার উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন বাবা-মা তাদের নিজের পছন্দের একটা রং। ফলস্বরুপ, সন্তানের ‘পারসেপচুয়াল ডেভেলপমেন্ট’ অর্থাৎ ‘ধারণার বিকাশ’ এ বাধাগ্রস্ত হয়, নিজের মতো করে সে ভাবতে পারে না, নিজের পছন্দ-অপছন্দ তার মাঝে তৈরি হয় না। তার শারীরিক বৃদ্ধির সাথে সাথে মানসিক বৃদ্ধি হচ্ছে না। ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে তাকে প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। পিছিয়ে থাকছে সে সমবয়সী সকলের থেকে। এতে করে সন্তান বিভিন্নভাবে নিজেকে একা ভাবতে শুরু করে। একদিকে সমবয়সীদের সাথে তাল মিলাতে না পারায় তাদের সাথে দূরত্বের সৃষ্টি। অন্যদিকে বাসায় বাবা-মা’র বিভিন্ন ধরনের চাপ। এ দুই কিংবা তারও বেশি কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে সন্তান অনেকটা অস্বস্তি কিংবা হতাশায় ভোগে। ফলস্রুতিতে সে নিজেকে শান্ত করতে যে কোন ধরনের অপরাধ জগতের সাথে কিংবা ভয়ংকর কঠিন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে দ্বিধা করছে না। এ জন্য কাকে দায়ী করছেন আপনি? পরিবেশ? বন্ধুবান্ধব? সমাজ? না নিজেকে? অবশ্যই আপনাকে এ দায়ভার নিতে হবে।

তুমি এ কাজ করতে পারবে না, এ সাবজেক্ট তোমার সাথে যায় না, ওই সাবজেক্ট পরতে হবে। সায়েন্স তোমার পছন্দ? তাতে কি? তুমি তো উকিল হবা, ডাক্তার হবা, ইনঞ্জিনিয়ার হবা। নিজের পছন্দ ভুলে যাও আমরা কি বলি সেটা শোনো। তোমার কি সে বয়স হয়েছে, যে নিজের ক্যারিয়ার বাছাই করবা! আমাদের কি কোন বুদ্ধি নেই? অমুক ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে আমার, তুমি এই সাবজেক্ট নিয়েই পড়বা। মান সম্মান যেভাবে রক্ষা হয় সেভাবে চল। অমুকের ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল সাবজেক্ট নিয়ে পরছে, তমুকের ছেলে ডাক্তারিতে চান্স পাইছে এবার তুমি ভাল কোথায় নিজের ঠাঁই না করতে পারলে মান–ইজ্জত ধুলিসাৎ হয়ে যাবে। শুধু কি তাই? নিজের পছন্দমত বন্ধু পর্যন্ত নির্বাচন করতে পারে না আজকাল বাচ্চাগুলো। খাবারের টেবিলে বসবে! এটা খাও ভিটামিন আছে, ওটাতে আয়রন। আরও কত কি? অনেক বাবা-মা আছেন যারা জানেনও না এসব কি করছেন কিংবা এর পরিণতি কি হতে পার। নিজের জানা স্বত্বে কিংবা অজান্তে বাচ্চাদের কতটা ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে সেটা কি ভাবছেন কোন বাবা-মা!

অনেক বাবা-মা কে ই বলতে শোনা যায়, ‘অমুক প্রফেশন আমার খুবই পছন্দের ছিল। পরিবারের জন্য করা হয়নি তাই চিন্তা করছি আমার সন্তানকে দিয়ে নিজের ইচ্ছাপূর্ণ করব। নিজে পারি নি তাতে কি? সন্তান করবে!’ তারপর শুরু হয় নিজের পছন্দের প্রফেশনাল কাজের জন্য তৈরি করা। কিন্তু একবার ও কি পরখ করে দেখেছেন আপনার এই পছন্দের ব্যাপারটা আপনার সন্তানের কতটা পছন্দ কিংবা অপছন্দের! সন্তানের অপছন্দের কিছু জিনিস যখন তার উপর চাপিয়ে দিবেন স্বভাবতই সে এসবের প্রতি বিরক্তবোধ করবে। তার উপর একদিকে চাপিয়ে দিলেন কিছু অপছন্দের বিষয় সে সাথে আশা করবেন এগুলো থেকে সে যেন আবার গোল্ডেন A+ পায়। রেজাল্টের দিন পাশের বাসার ছেলে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার বন্ধুর ছেলে গোল্ডেন A+ পাইছে, আপনার সন্তান পায়নি। কেন হলো না আশানুরুপ রেজাল্ট সেটা না খুঁজে আপনি লেগে গেলেন আপনার ইজ্জত হারানোর চিন্তায়। মান-ইজ্জত উদ্ধার করতে সন্তানের উপর চালাচ্ছেন অমানবিক শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার। ফলশ্রুতিতে সন্তান আত্মহত্যার মত ভয়াবহ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে দ্বিধা করে না।

প্রতিটি শিশুর মনোসামাজিক বিকাশের ধারার অন্যতম হচ্ছে একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে, নিজের ভালোলাগা-মন্দ লাগা নিয়ে বেড়ে ওঠা। আর এই বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়েই সুগঠিত হয় তার ব্যক্তিত্ব। শিশুকে নিজের মতো করে বড় হতে না দিলে ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। পরিণত বয়সে তার অন্যের সঙ্গে মানিয়ে চলতে, স্বাভাবিক আচরণ করতে বেগ পেতে হয়।

‘বাবা-মা হিসেবে অবশ্যই আমরা সন্তানের ভালর জন্যই সব করে থাকি’ হ্যাঁ। বাবা-মা হিসেবে সন্তানের ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব আপনার। কিন্তু সব ব্যাপারে তার উপর আপনার পছন্দ-অপছন্দ চাপিয়ে জেতা টাই ভাল প্যারেন্টিং এর মাঝে পরে না। যে বিষয়ে সন্তানের ক্ষতি হবে সেগুলো থেকে অবশ্যই বিরত রাখবেন। যেমন: সোশ্যাল মিডিয়াতে অতিরিক্ত সময় না দেয়া, সময় মতো ঘুমানো সহ দৈনন্দিন কাজগুলো ঠিক সময় করা। কিন্তু তাদের যে অভ্যাসগুলো মোটেই ক্ষতিকর নয়, যা শিশুর একান্ত নিজস্ব পছন্দ–অপছন্দ, সেগুলোয় যদি তার কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি না হয়, তবে জোর করে সেগুলো পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই। যেমন: শিশুর স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস, পছন্দের ফ্যাশন (যদি সেটা পরিবার কিংবা সমাজের একেবারেই বিপরীতে না হয়), পছন্দের খেলা ইত্যাদি।

আপনার সন্তানের প্রতিটা পছন্দ-অপছন্দ, চাহিদাকে গুরুত্ব দিন। নিজের সন্তানের মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে যাবেন না। সব সময় মনে রাখবেন, পুরোপুরি দুটো সত্তা এক হয় কিভাবে? এটা বরং আপনার সন্তানের স্বকীয়তাকে ঢেকে দিতে পারে। সন্তানের স্বভাবজাত নিজস্বত্তাকে ফুটিয়ে তুলতে, তাদের সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে সন্তানের নিজের পছন্দটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দিন।

লেখক: সুরমা রহমান, শিক্ষক ও সমাজকর্মী, লন্ডন, ইউকে

বিডি২৪লাইভ/টিএএফ

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: