অবহেলিত মৃৎ শিল্প, ডাক পড়ে শুধু পহেলা বৈশাখে
একসময়ে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও সুনাম অর্জন করা মৃৎ শিল্প আজ কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে। সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের সু নজর না থাকলে নওগাঁর মৃৎশিল্প হারিয়ে যাবে অতল গহ্বরে। মৃৎ শিল্পকে রক্ষা করা এখন সময়ের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, বৃটিশ শাসনকালে ভারতের কুচবিহার রাজ্য থেকে মৃত বাল্যক রামপাল তার তিন ভাইকে সঙ্গে নিয়ে নওগাঁর ধামইরহাটে আসেন এবং কয়েক শতক জমি কিনে সেখানে তাদের ঐতিহ্যবাহী মৃৎ শিল্প ব্যাবসা কার্যক্রম বিস্তার লাভের জন্য ব্যাবসা শুরু করেন। এভাবে কালের বিবর্তনে একে একে ১৩তম বংশ পেরিয়ে বর্তমানে চৌদ্দ তম পুরুষের হাল ধরেছেন রামায়ণ প্রসাদ পাল (৮৫)। বয়সের ভারে তিনি এখন নানান অসুখ বিসুখে আক্রান্ত।
রামায়ণ প্রসাদ পাল বলেন, আমার বাবার দাদা মৃত বাল্যক রামপাল তিন ভাইকে সঙ্গে নিয়ে এখানে মৃৎ শিল্পের কাজ শুরু করেন, বাবার দাদার বড়ো ভাই মৃত দীপ নারায়ণ পাল তখন এই এলাকার একজন বিখ্যাত মৃৎ শিল্পী ছিলেন, সবাই তাকে মৃৎ শিল্পের যাদুকর বলে ডাকতেন। তিনি বলেন আমি এখন ১৪ তম পুরুষের হাল ধরে আছি, বয়সের ভাড়ে আমি প্রায় সাত বছর আগে বিছানায় শয্যাশায়ী কোন কাজকর্ম করতে পারিনা, আমার তিন ছেলে তারা কেউই আর মাটির কাজ করতে চায়না, বড় ছেলে মহেশ কুমার পালকে আমার বাপদাদার পুর্বপুরুষের ঐতিহ্য মৃৎ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করতে বললেই বলে ওঠে বাবা তোমাদের সময় সাহেব বাবু থেকে শুরু করে সবাই সম্মান দিত, গৃহস্থালি কাজে সবাই আমাদের পণ্য সামগ্রী কিনতো দিনে কয়েক হাজার টাকার ব্যবসা হতো। ১ দিনে বিশ টাকার পণ্য সামগ্রী বিক্রি করে দিব্যি সংসার চালানো যেত, এখন তা সম্ভব নয়। এখন শুধুমাত্র পহেলা বৈশাখেই আমাদের খোজে সাহেব-বাবুরা, বৈশাখ পেরুলেই আর কেউ খোজ রাখেন না। তাই প্রয়োজনে ভ্যান রিক্সা চালাবো, মানুষের বাসায় কাজ করবো এখন মৃৎ শিল্প দিয়ে আর সংসার চলবেনা।
বর্তমানে অভাবগ্রস্থ সংসারে সন্তোষ কুমার পাল আমাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য মৃৎ শিল্পকে লালন পালন করছে। দ্বিতীয় ছেলে সন্তোষ কুমার পাল ভারাক্রান্ত কন্ঠে আক্ষেপ করে বলেন, বর্তমান সময়ে মাটির কাজের কোন সম্মান নেই, ক্রেতাও আগের মতো নেই, মাটির দাম বেশি শ্রমের মূল্যও অনেক বেড়ে গেছে, প্লাস্টিক, মেলামাইন আর স্টীলের অসাস্থ্যকর পণ্যে চারিদিকে ছেয়ে গেছে। সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের সুনজর না থাকলে আমরাও হারিয়ে যাবো অতল গহ্বরে। এ অশনিসংকেত থেকে আমাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য মৃৎ শিল্পকে রক্ষাকরা এখন সময়ের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
অপরদিকে উক্ত উপজেলার হাটনগর এলাকার বসবাসকারী মো: ইউসুফ মুর্তজা রহমান বলেন আমাদের এখানেও গজেন্দ্র পাল, ঝোপরা পাল, সুধীর পাল, রমেশ পাল, ধীরেণ পাল, জাগোয়া পাল, জথরু পাল, মথরু পাল সহ প্রায় ১০/১৫ টি পরিবার মৃৎ শিল্পের কাজ করতেন। মাটির দুস্প্রাপ্যতা, ক্রেতা কমে যাওয়ায় মৃৎ শিল্প হুমকির মুখে পড়লে নিজ পেশা ত্যাগ করে তারা অন্য পেশায় যোগদান করে।
এ বিষয়ে ধামইরহাট উপজেলার ইতিহাস নিয়ে গবেষনাকারী সরকারী এমএম কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ মোঃ শহীদুল ইসলাম বলেন, আগের যুগের মানুষ বাঁশ-বেতের তৈরী নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো, তাদের সাংসারিক জীবনে মৃৎ শিল্পীদের তৈরী মাটির থালা-বাসন দিয়ে রান্না-বান্না ও খাবার পরিবেশন করতো, মাটির কলসে পানি রাখতো। বর্তমানের আধুনিকতার ফ্রিজিং পানির চেয়ে কলসের পানিকেই সুপেয় পানি মনে করতো তখনকার মানুষেরা, যা যুগে যুগে আধুনিকতায় বিলিনের পথে, কাষা, স্টীল, সিরামিক, মেলামাইনসহ নানা আধুনিক জিনিসপত্রের দিকে ঝুকছে বর্তমান সমাজ, ফলে মৃৎ শিল্পের গুরুত্ব দিনে দিনে কমে যাচ্ছে।
অবহেলিত এই মৃৎ শিল্পীদের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার গনপতি রায় বলেন, প্রায় বিলুপ্তির পথে মৃৎ শিল্প বলা হলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিশেষ করে মেলা গুলোতে মাটির তৈরী জিসিতপত্রই মেলার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়, ক্ষুদে-শিশুরা তাদের নির্ঘুম পরিশ্রমে তৈরী খেলনা-জিনিসপত্রে পাগল প্রায়, এই শিল্পকে আরও আধুনিক করতে তাদের যুগপোযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আন্তনির্ভশীল করে গড়ে তোলা হবে, যাতে করে তারাও আধুনিক জীবন যাপন করতে পারে। প্রয়োজনে তাদের সমাজসেবা, মহিলা বিষয়ক অফিস, যুব উন্নয়ন ও সমবায় অফিসের মাধ্যমে ঋণ প্রদান করে মৃৎ শিল্প তথা বাঁশ-বেত শিল্পকেও সমাজ-ব্যবস্থা স্বীকৃতি প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
বিডি২৪লাইভ/আরআই
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]
পাঠকের মন্তব্য: