নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়ে পানি নিয়ে এসেছিল নুর উদ্দিন!

প্রকাশিত: ১৮ এপ্রিল ২০১৯, ১০:২৩ পিএম

শেষ পর্যন্ত বাঁচানো গেলো না নুসরাত জাহান রাফিকে। মা-বাবার আর্তি, সতীর্থসহ সকলের প্রার্থনা আর চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে পাঁচদিন একটানা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বুধবার (১১ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯ টার দিকে না ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি।

নুসরাতের শরীরে আগুন দেয়ার ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের জনগণ। সর্বত্র উঠেছে বিচারের দাবি।

এদিকে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে হত্যার ঘটনায় দায় স্বীকার করে আরও একজন জবানবন্দি দিয়েছেন।

বুধবার (১৭ এপ্রিল) বিকালে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শরাফ উদ্দিন আহমেদের আদালতে আবদুর রহিম ওরফে শরিফ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ নিয়ে তিনজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন।

এর আগে ১৪ এপ্রিল ফেনীর আদালতে জবানবন্দি দেন দুই আসামি নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন সেলিম। তাদের বক্তব্যে জানা গেছে রাফির গায়ে আগুন দেয়ার ঘটনার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের আদ্যোপান্ত।

তিনজনের স্বীকারোক্তিতেই জানা গেছে, অধ্যক্ষের নির্দেশেই তারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটান। বিষয়টি নিয়ে তাদের দফায় দফায় বৈঠকও হয়। কারা কী করবেন সেটার পূর্ণাঙ্গ একটি ছকও আঁকেন। তাদের স্বীকারোক্তিতে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়ার পাওয়া গেছে রোমহর্ষক বর্ণনা।

এর আগে পিআইবিও জানিয়েছিল, অধ্যক্ষের নির্দেশেই নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।

সূত্র জানায়, নুর উদ্দিনের জবানবন্দিতে জানান, ২৭ মার্চ পিয়ন দিয়ে নুসরাতকে নিজের কক্ষে ডেকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন সিরাজ। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় কারাগারে যান অধ্যক্ষ সিরাজ। সিরাজের সঙ্গে ফেনী কারাগারে দেখা করতে যান নুর উদ্দিন, হাফিজ, আফছার, আলাউদ্দিন, জনি, মাকসুদ। তারা দেখা করতে গেলে তাদের কিছু করার নির্দেশ দেন অধ্যক্ষ। আওয়ামী লীগ নেতা ও কাউন্সিলর মাকসুদকে জানানোর পর সিরাজউদ্দৌলা মুক্ত পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। যার আহ্বায়ক হন নুর উদ্দিন। ২৮ মার্চ অধ্যক্ষের পক্ষে মানববন্ধন করেন তারা। সিদ্ধান্ত হয় ৩০ মার্চ আবার মানববন্ধন করার।

১ এপ্রিল কারাগারে দেখা করতে যান সিরাজের দুই ছেলেসহ ১২ জন। দ্রুত কিছু করার নির্দেশ দেন সিরাজ। ৩ এপ্রিল তারা সবাই আবার দেখা করতে যান। প্রয়োজনে নুসরাতকে হত্যার জন্য সিরাজ আলাদা নির্দেশ দেন নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামিম, হাফেজ কাদের, জাবেদ ও জোবায়েরকে।

৪ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত চূড়ান্ত বৈঠক হয়। উপস্থিত ছিলেন নুর, শামিম, কাদের, জোবায়ের, জাবেদ, মহিউদ্দিন শাকিল, মো. শামিম, ইমরান, ইফতেখার ও শরীফ। হত্যার প্রস্তাব উত্থাপন করেন নুর উদ্দিন, শাহাদাত শামিম ও হাফেজ কাদের। পরিকল্পনার কথা কাউন্সিলর মাকসুদকে জানালে ১০ হাজার টাকা দেন। এর আগে মাদ্রাসার ইংরেজি শিক্ষক সেলিম আরও পাঁচ হাজার টাকা দেন।

৬ এপ্রিল পরিকল্পনা মতো মাদ্রাসার গেটে অবস্থান নেন নুর উদ্দিনসহ পাঁচজন। নুসরাতের সঙ্গে আসা ভাই নোমানকে ঢুকতে দেননি নুর উদ্দিন। সাইক্লোন সেন্টারের নিচে পাহারা দেন মহিউদ্দিন শাকিল ও শামীম।

গায়ে আগুন নিয়ে সাইক্লোন সেন্টারের নিচে নেমে আসে নুসরাত। তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে পরীক্ষার হলে থাকা পুলিশ কনস্টেবল ও মাদ্রাসার নিরাপত্তারক্ষীরা। গায়ে আগুন দেয়ার পর সে দৌড়ে নিচে এলে সবার সামনে পানি নিয়ে আসে নুর উদ্দিন। এমনকি হাসপাতালে নিতে সিএনজি অটোরিকশাও ঠিক করে দেন তিনি। পরে অন্যদের সঙ্গে কথা বলে, ময়মনসিংহে আত্মগোপন করেন নুর উদ্দিন।

নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ায় সরাসরি অংশ নেয়া শাহাদাত হোসেন শামীমের জবানবন্দিতে জানা যায়, দেড় মাস আগে নুসরাত জাহার রাফিকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হন তিনি। পুরনো ক্ষোভ থেকেই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলার পর তাকে বাঁচাতে উদ্যোগী হন তিনি।

জবানবন্দিতে শামীম জানান, ৪ এপ্রিল রাতে সাড়ে ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত চূড়ান্ত বৈঠকে আগুনের পোড়ানোর প্রস্তাব উপস্থাপন করেন তিনি। কেরোসিন কেনার দায়িত্বও নেন তিনি। রাফিকে দ্বিধায় ফেলতে পপিকে শম্পা নামে ডাকারও সিদ্ধান্ত হয়। থানা ও মামলার বিষয় উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন ও কাউন্সিলর মাকসুদ দেখবেন বলে নিশ্চয়তা পাওয়া যায়।

জবানবন্দিতে জানা যায়, পরিকল্পনা মতো, উম্মে সুলতানা পপি ডেকে আনবে রাফিকে, তিনজনের জন্য বোরকা আনবে কামরুন্নাহার মনি আর কেরোসিন কিনবে সে নিজেই। বৈঠকের সিদ্ধঅন্ত জানানো হয় কাউন্সিলর মাকসুদ, ইংরেজি শিক্ষক সেলিম ও আফসার, অধ্যক্ষ সিরাজের দুই ছেলে মিশু ও আদনানসহ পপি এবং মনিকে। সবাই একমত হয়।
৬ এপ্রিল সকালে মাদ্রাসায় এসে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বোরকা পরে তৈরি হয় সবাই। সাড়ে ৯টার দিকে মনির আনা বোরকা পরে শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের। পৌনে দশটায় পপি রাফিকে ডেকে আনে তার বান্ধবী নিশাতকে মারধর করা হচ্ছে বলে। দুজনের পেছনে ছাদে ওঠে চারজন। রাফিকে প্রথমে ধরে পপি ও মনি। শামীম মুখ চেপে ধরে। মাটিতে ফেলে ওড়না দিয়ে হাত পা বাঁধে জোবায়ের। পরে এক লিটার কেরোসিন ঢেলে ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগুন দেয় জোবায়ের। যাতে লাগে প্রায় পাঁচ মিনিট।

ঘটনার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনকে ফোন করে বিস্তারিত জানায় শামীম। পরে আত্মগোপন করে মুক্তাগাছায়। সেখান থেকেই শামীমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
বুধবার আবদুর রহিম স্বীকারোক্তিতে বলেন, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার নির্দেশে ও পরামর্শে নুসরাতকে হত্যার জন্য গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগানো হয়। এ জন্য ২৮ ও ৩০ মার্চ দুই দফা কারাগারে থাকা মাদ্রাসার অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করেন। ৪ এপ্রিল সকালে অধ্যক্ষ সাহেব ‘মুক্তি পরিষদের’ সভা করা হয়। রাতে ১২জনের এক সভায় হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত ও দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। তার (রহিম) দায়িত্ব পড়ে মাদ্রাসার গেটে। সেখানে নুর উদ্দিন, আবদুল কাদেরও ছিলেন। মাদ্রাসার ছাদে বোরকা পরে ছিলেন শাহাদাত, জোবায়ের ও জাবের। এ ছাড়া ছাদে ছিলেন মণি ও পপি।

বিডি২৪লাইভ/এআইআর

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: