
তিলোত্তমা নগরী ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ায় মুম্বাইয়ের পরে দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক শহর। তবে আধুনিক সভ্যতার যুগে আমাদের এই অন্যতম প্রাচীন নগরীর রুপ লাবণ্য দেখে বোঝা দায়, আমরা কবে কখনও এর যত্ন নিয়েছিলাম কি-না। তবে সর্বোতভাবে নগরীর জীবনযাত্রার গতি আমাদের অনেক বেশি থমকে দিচ্ছে সাম্প্রদায়িক সময়ে।
গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, যানজটের কারণে ঢাকা মহানগরীতে দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে কর্মজীবীদের, যার আর্থিক ক্ষতি বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি রাজধানীর খামারবাড়ির বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের (কেআইবি) মিলনায়তনে ‘দ্য ফিউচার প্ল্যানিং আরবান ট্রান্সপোর্টেশন ইন ঢাকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিষয়টি আমাদের জন্য উদ্বেগের। তবে স্বস্তির বিষয় হলো, রাজধানী ঢাকাকে নিয়ে বর্তমান সরকারের নানাবিধ উদ্যোগ আশা জাগাচ্ছে। কিন্তু একইভাবে শঙ্কা তৈরী করছে যে, নাগরিক পর্যায়ে সকল উদ্যোগের সদ্ব্যবহার কতটুকু নিশ্চিত হবে।
প্রশ্ন আছে ঢাকার জনসংখ্যা কত? ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হিসাবেও বিষয়টি স্পষ্ট ছিল না। পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের আওতায় বিবিএস’র সর্বশেষ জনশুমারি প্রতিবেদনে এ সংখ্যা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা উত্তর সিটির জনসংখ্যা ৫৯ লাখ ৭৯ হাজার ৫৩৭ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটির জনসংখ্যা ৪২ লাখ ৯৯ হাজার ৩৪৫। সে হিসাবে দুই সিটি করপোরেশনের মোট বাসিন্দা ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৮২ জন। কিন্তু এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য আমরা এখনও সুষ্ঠু পরিবহন বিশেষত গণপরিবহন নিশ্চিত করতে সক্ষম হইনি। বরং গণপরিবহনে কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্রমান্বয়ে নাগরিকরা ব্যক্তিগত গাড়ির দিকে ঝুঁকছে। ফলে পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকায় সৃষ্টি হচ্ছে অসীম যানজট।
আরেকটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ ঢাকায় জনসংখ্যা হবে ৩ কোটি। এ প্রেক্ষাপটে যানজট নিরসনে উদ্যোগ নেয়ার সময় এখনই। রাজধানী ঢাকাকে সবার জন্য বসবাসের উপযোগী করতে হলে সুদূরপ্রসারী ও সমন্বিত মহাপরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন জরুরি।
২০২২ এর জুলাই পর্যন্ত বিআরটিএর এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ১৮ লাখ ৯৩ হাজার ৫৩৪ বৈধ রেজিস্ট্রেশন করা বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচল করছে। ২০২০ সালে ঢাকার সড়কে এক লাখ ১৮ হাজার এবং ২০২১ সালে এক লাখ ৫০ হাজার নতুন যানবাহন নেমেছে। যেখানে শুধুমাত্র ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত নতুন রেজিস্ট্রেশন দেয়া বিভিন্ন ধরনের গাড়ির সংখ্যা ১ লাখ ১২ হাজার ৯৩৭টি। প্রতিদিন গড়ে ৫৩০ যানবাহনের নতুন লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে। আর সেসঙ্গে প্রতিদিন সড়কে যুক্ত হচ্ছে এসব নতুন গাড়ি। পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায়, লাফিয়ে বাড়ছে পরিবহনের সংখ্যা। কিন্তু নিশ্চয়ই সে অনুযায়ী আমাদের পরিকল্পিত রাস্তা নেই। আবার রাস্তা থাকলেও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ এবং ফুটপাত দখলের ফলে রাস্তা আরও সংকুচিত হয়েছে। ফলে যানজটে নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা। গতি কমছে শহরের।
বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতিবেগ প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার। যেখানে ২০০৭ সালে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। অর্থাৎ দেড় দশকে ঢাকায় যানবাহন চলাচলের গড় গতি কমে গেছে ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটারের মতো। সব মিলিয়ে ঢাকার সড়ক দিন দিন নিশ্চল হওয়ার পথেই এগিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু আমাদের এখনই কারণ খুজে বের করা দরকার। নিশ্চয়ই ঢাকার গতি এমন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেলেও নগরীর মানুষের চলাচলে দুর্ভোগ তেমন কমে নি। বরং এখনও প্রায় নিয়মমাফিক কর্মজীবী নারী পুরুষদের যাতায়াতে গণপরিবহন নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এমনকি একপ্রকার গাদাগাদি করেই তাদের যাতায়াতের চিত্র প্রায়শই গণমাধ্যমের কল্যানে উঠে আসে। কিন্তু তাহলে গতি কমার মৌলিক কারন কি!
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর হিসাবমতে, তিলোত্তমা নগরী হিসেবে খ্যাত রাজধানী ঢাকার ৭৭ শতাংশ রাস্তা দখল করে রাখে প্রাইভেট কার। রাইড শেয়ারিংসহ এসব ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহারকারী রাজধানীর ১৫ শতাংশ মানুষ। এর মানে রাজধানীর ৮৫ শতাংশ মানুষ ব্যবহার করছে ২৩ শতাংশ রাস্তা।
প্রতিদিন যারা যাতায়াত করেন, বিশেষ করে যারা সপ্তাহে ছয়দিন অফিসে যান, তাদেরকে যানজট পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নীতি-নির্ধারণী পর্যায় থেকে প্রাইভেট কারকে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে বেশি, তুলনায় গণমানুষের জন্য গণপরিবহন সবসময় উপেক্ষিত থেকেছে। এমনকি যে বিআরটিসি’র সাধারণ মানুষের জন্য গণপরিবহন চালানোর কথা তারা তাদের বাস উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়ে রেখেছে।
ঢাকার রাস্তায় এত ট্র্যাফিক জ্যাম কেন? আর এর সমাধানই বা কী? সমাধান আছে! আমাদের অর্থাৎ জনগণ, পরিবহন চালক, ট্রাফিক আর পুলিশ প্রশাসনকে আরও সচেতন এবং নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাদের সভ্য হতে হবে। সড়ক সংশ্লিষ্টদের আইনের যথার্থ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। যেদিন জনগণ রাস্তার আইন মানবে, ট্রাফিক পুলিশ ঘুষ না খেয়ে রাস্তায় ঠিকঠাক যানজট কমানোর কাজ করবে, চালকগণ ট্রাফিক নিয়ম মেনে রাস্তায় পরিবহন চালাবে, ফুটপাতে দোকানদারি বন্ধ হবে সেদিনই রাজধানী ঢাকার যানজট কমে আসবে। ঢাকা থেকে ছোট যানবাহন কমাতে হবে, সর্বোপরি সরকার সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে।
বিআরটিএর হিসাব বলছে, প্রতিদিন রাস্তায় ১ হাজার ৪০৯টি মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার ৫০টি, আর বাস নামছে ১০টি। তবে এর ৩ ভাগের ১ ভাগই ঢাকায়।
ডিসিসির এক গবেষণা থেকে জানা যায়, একটি আধুনিক নগরীর মোট আয়তনের ২৫ ভাগ রাস্তা থাকা অত্যাবশ্যক। মহানগরী ঢাকায় মাত্র ৭ ভাগ রাস্তা রয়েছে। আবার সেই রাস্তাও ঠিক মতো ব্যবহার হয় না। নগরীর বেশির ভাগ রাস্তাই দখল করে থাকে ব্যক্তিগত গাড়ি। ৭ ভাগ রাস্তার মধ্যে ৬০ ভাগ দখল করে থাকে ৮ ভাগ লোকের ব্যক্তিগত গাড়ি।
রাজধানীর যানজট সহনীয় মাত্রায় আনতে স্বল্পগতির যানবাহন ও প্রাইভেট কারের সংখ্যাধিক্যের দিকে নজর দেওয়া দরকার। ট্রাফিক আইন যাতে সব ক্ষেত্রে কড়াকড়িভাবে মানা হয় সেই ব্যাপারেও যত্নবান হতে হবে। ফুটপাত থেকে দোকানপাট উঠিয়ে দেওয়া, যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং দিনের ব্যস্ত সময়ে প্রাইভেট কার চলাচল কমিয়ে আনার কথাও ভাবতে হবে।
ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার কমানোরও উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। গাড়ির ব্যবহার কমাতে প্রথমেই গণপরিবহন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী এবং ঢেলে সাজাতে হবে। প্রয়োজনে পার্কিংয়ের সুবিধা কম দিতে হবে। গাড়িগুলোর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তবে সবার আগে যথাযথ গণপরিবহন নিশ্চিত না করলে ব্যক্তিগত গাড়ি কমানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। কারণ প্রতিটি মানুষ তার সামর্থ্যের মধ্যে থেকে সেবার সর্বোচ্চ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। সেটি পূরণে যদি সরকার ব্যর্থ হয় তাহলে সেটি হবে নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন করা। সর্বোপরি দীর্ঘস্থায়ী এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করা গেলে রাজধানী ঢাকাকে বাসযোগ্য শহরের কাতারে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। সেইসাথে গতি বাড়বে আমাদের জীবনমানের। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে আরও দীর্ঘস্থায়ী।
লেখক: ড. জান্নাতুল ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই লেখার সাথে পত্রিকার কোন সম্পর্ক নেই। এ লেখাটি সম্পূর্ণ লেখকের একান্ত নিজস্ব মতামত।
সর্বশেষ খবর