বছরের পর বছর নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে ফেনীর ছাগলনাইয়ার শুভপুর ও ঘোপাল ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে বসতবাড়ি, মসজিদ ও কবরস্থান। কয়েক বছর আগে যে-সব জায়গায় বিভিন্ন মৌসুমি ফসল চাষাবাদ হতো, সে এলাকা এখন নদীর পানিতে থই থই করছে। বালু উত্তোলনের ফলে ফেনী নদী এতই প্রশস্ত হয়েছে যে, সাধারণ মানুষের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও কবরস্থান নদীতে বিলীন হচ্ছে। অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয়রা।
সরেজমিন দেখা গেছে, বালু উত্তোলনের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গেছে। শুভপুর ব্রিজের অদূরে নদী থেকে শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে শক্তিশালী খননযন্ত্র দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে জয়পুর, লাঙ্গলমোড়া ও কাটা পশ্চিম জোয়ার এলাকার দেড় হাজার একর জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদীর পাড়ের জমিগুলোয় শসা, তরমুজ, ধনিয়া, সরিষাসহ শীত ও গ্রীষ্মকালীন সবজি আবাদ হয়। কিন্তু নদী থেকে বালু উত্তোলনের কারণে আশপাশের জমিগুলো নদীতে বিলীন হওয়ার পথে।
লাঙ্গলমোড়া এলাকার আমিন হাজী বাড়ির বাসিন্দা ডা. নুরুল আমিন হেলাল জানান, বালু তোলার কারণে তার ১০ শতাংশ ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে। বিশাল এলাকা ভেঙে নদীর গতিপথও পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখনো ভাঙন চলমান রয়েছে। আরও ২৯ শতাংশ জমি রয়েছে।
সেগুলোও হুমকির মুখে। ঘোপাল ইউনিয়নের কাশেম আলী দীর্ঘদিন ধরে নিজের জমি রক্ষায় সংগ্রাম করছেন। দিন-রাত বালুখেকোদের পাহারা দিয়ে তাড়িয়েছেন। তিনি জানান, তার আর হারানোর কিছু নেই। তিনি বলেন, 'আমরা নিজেরা রাত-দিন পাহারা দিয়ে আর কত তাড়াব। যেভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে তাতে আমাদের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, মসজিদ সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।' দ্রুত সময়ের মধ্যে বালু উত্তোলন বন্ধ করার দাবি জানান তিনি।
জমির উদ্দিন নামে স্থানীয় আরেক বাসিন্দা জানান, বালু উত্তোলনের কারণে ছয় কিলোমিটার দূরে থাকা নদী এখন বাড়ির কাছে চলে এসেছে। জোয়ারের পানিতে মসজিদ, রাস্তাঘাট- সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়। পরিবারে শুধু দুই মেয়ে। নিজের ভূমি কোন দিন হারিয়ে ফেলেন সেই চিন্তায় ঘুম আসে না তার। আগে যে জমিতে আবাদ করতেন এখন সেখানে পানি। জমির উদ্দিন বলেন, 'আমরা বাঁচতে চাই। দুবেলা দু-মুঠো খেয়ে যাতে বাঁচতে পারি তার জন্য এ বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে।'
জয়পুর এলাকার বাসিন্দা অলি আহম্মদ জানান, ৪০ শতক জমি বিলীন হয়ে গেছে। বাকি ৪০ শতক জমিতে তিনি মৌসুমি ফসল আবাদ করেন। শাফায়েত শুভ নামে এক ব্যক্তি জানান, বালু তোলায় জড়িতরা ক্ষমতাসীন দলের নেতা হওয়ায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। দিনের বেলায় বন্ধ থাকলেও রাতের আঁধারে ড্রেজার দিয়ে তারা বালু তোলেন।
নার্গিস সুলতানা নামে আরেকজন বলেন, বসতবাড়ি, ফসলি জমি, ভিটেমাটি একে একে সব কেটে নিয়ে যাচ্ছে। আমার জীবন তো শেষ। আমার ছেলেমেয়েদের এখানেই বিয়ে দিয়েছি। তাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নেই। এভাবে চলতে থাকলে এক দিন রাস্তায় গিয়ে উঠতে হবে। এলাকাবাসীর দাবি, পাঁচ হাজার একর জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। দূরদূরান্তে যত পানি দেখা যায়, সবগুলো একসময় আবাদি জমি ছিল।
ইয়াজ রহমান নামে একজন বলেন, বালু তোলার কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেচ প্রকল্পও নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ সমস্যার সমাধান হওয়া খুব জরুরি। অন্যথায় এলাকার মানুষ সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে হুমকির মুখে পড়বে। ফেনী জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার বলেন, ছাগলনাইয়া উপজেলার শুভপুর ও ঘোপাল ইউনিয়নে বালু উত্তোলনে কারণে ক্ষতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ পাওয়ার পর বালু উত্তোলন বন্ধ রাখা হয়েছে। বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে শুভপুর ও ঘোপাল এলাকায় বালু তোলার বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়), পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নেতিবাচক রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। আগামী বছর ছাগলনাইয়া উপজেলায় বালুমহাল না রাখতে বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর