বরিশালের আশপাশের গ্রামেও একে একে অকেজো হচ্ছে টিউবওয়েল। দীর্ঘসময় চাপার পরও এসব কলে উঠছে না পানি। শনিবার বরিশালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর সঙ্গে চাপকলে পানি না ওঠার নতুন এ বিপদ যোগ হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ।
উত্তাপের বিপদ সংকেতের মধ্যেই মাইলের পর মাইল দূরে গিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের। পরিস্থিতি সামাল দিতে সংকটাপন্ন এলাকাগুলোয় ১৩০টি মেশিনে চলা পানির পাম্প বসানোর কাজ করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। তবে তাতে সংকটের ছিটেফোঁটাও মিটবে না বলছে ওইসব এলাকার জনগণ।
বরিশাল নগর থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দূরে রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়ন। সেখানকার বাসিন্দা শাহজাহান (৫৫) বলেন, গত ক’দিন এখানে কোনো টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চাপার পরও একই অবস্থা।একই কথা বলেন নগর সংলগ্ন কাশিপুর ইউনিয়নের তিলক কলাডেমা এলাকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম।
তিনি বলেন, গরমের তীব্রতা বাড়ার আগে ২-১টা টিউবওয়েলে যাও পানি উঠত এখন আর তাও মিলছে না। আশপাশের যে-সব বাড়িতে টিউবওয়েলের সঙ্গে পানি ওঠানোর পাম্প (সাবমারসিবল) লাগানো আছে তারাই কেবল পানি পাচ্ছে। আমরা যারা সাধারণ টিউবওয়েল ব্যবহার করি তাদের টিউবওয়েল অনেকক্ষণ চাপার পরও পানি ওঠে না।
জাগুয়া ইউনিয়নের হুমায়ুন কবির বলেন, পানি না ওঠার কারণ জানতে গিয়েছিলাম উপজেলা ইঞ্জিনিয়ারের কাছে। তিনি বলেছেন, পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে নাকি এ অবস্থা হয়েছে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উপরিভাগ থেকে ৮-১০ ফুট নিচে থাকলে চাপকল চেপে পানি ওঠানো সম্ভব। কিন্তু বরিশাল নগর সংলগ্ন ৫টি ইউনিয়নের পানির স্তর এতটাই নিচে নেমে গেছে যে টিউবওয়েল চেপে সেই পানি ওঠানো যাচ্ছে না।
এটা ঠিক এখনও মাটির ৯১০ থেকে ৯২০ ফুট নিচেই মিলছে সুপেয় পানি। কিন্তু স্তর চাপের অবস্থান ৮-১০ ফুট থেকে নেমে চলে গেছে ২৩-২৪ ফুট নিচে। যে কারণে একই সঙ্গে বিকল হয়ে পড়েছে শত শত টিউবওয়েল। এ সমস্যা দেখা দিয়েছে নগর সংলগ্ন ৫ ইউনিয়নে। আবার এসব ইউনিয়নের যে জায়গাগুলো নগর থেকে খানিকটা দূরে সেখানে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না।
এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে চরবাড়িয়া, চরকাউয়া, রায়পাশা-কড়াপুর, কাশিপুর এবং জাগুয়া ইউনিয়নে। সিটি করপোরেশন গঠিত হওয়ার সময় এসব ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকা নগরের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্ধিত এলাকা নামে পরিচিত সেসব এলাকাতেই বেশি সমস্যা হচ্ছে। বরিশাল নগর এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের নিম্নগামিতা কিন্তু আরও ভয়াবহ। মূলত তার প্রভাবই পড়ছে নগর সংলগ্ন এসব ইউনিয়নের ভূগর্ভস্থ স্তরে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ইমরান সাংবাদিকদের বলেন, বরিশাল নগরে টিউবওয়েলে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে অন্তত ৮-১০ বছর আগে। অগণিত বহুতল ভবন নির্মাণ ও এসব ভবনের বাসিন্দাদের পানির চাহিদা মেটাতে অপরিকল্পিতভাবে পাম্প বসিয়ে পানি ওঠানোর কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যুগ যুগ ধরে এভাবে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে আনায় ভূ-উপরিতল থেকে মাত্র ৮-১০ ফুট নিচে থাকা পানির স্তর নেমে গেছে ৪২-৪৩ ফিট নিচে।
ফলে এখন যে কেবল টিউবওয়েলে পানি উঠছে না তা নয়, সুপেয় পানির স্তর পর্যন্ত তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। আগে যেখানে বরিশাল নগরে ৭৫০ থেকে ৮শ ফুট নিচে গেলেই মিলত বিশুদ্ধ পানি সেখানে এখন সাড়ে ৯শ ফুট নিচে যেতে হচ্ছে। এখনই এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হলে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত বরিশাল নগরে পানির হাহাকার পড়বে।
রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আহম্মেদ শাহরিয়ার বাবু সাংবাদিকদের বলেন, এখানে কোনো টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। পুরো ইউনিয়নে হাতে গোনা কিছু সাবমারসিবল রয়েছে। খাবার পানি সংগ্রহে সেগুলোতেই ছুটতে হয় মানুষকে।
এছাড়া গোসলসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার হচ্ছে পুকুর কিংবা খালের পানি। চলমান হিট অ্যালার্মে একটু খাবার পানির জন্য মানুষ যে কতটা কষ্ট করছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করানো যাবে না। কথা ছিল জলবায়ু প্রকল্পের আওতায় এখানে বেশ কিছু ডিপ টিউবওয়েল বসানো হবে। কিন্তু টিউবওয়েলে পানি না ওঠায় এখন নাকি তাও বসানো হবে না।
বরিশাল সদর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী আবু সালেহ বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। আলোচ্য ৫ ইউনিয়নে আমাদের দেড় হাজারের মতো টিউবওয়েল রয়েছে যার অধিকাংশই কাজ করছে না।
রাজস্ব খাতভুক্ত একটি প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে এসব ইউনিয়নে ১৩০টি টিউবওয়েল বসানোর কাজ চলছে। এসব টিউবওয়েলে সাবমারসিবলের পাশাপাশি জলাধার বসানোর কাজ করছি আমরা। এখানে প্রতিটি টিউবওয়েলের সাথে থাকা জলাধারেও সংরক্ষিত থাকবে পানি। আগে যে-সব সাবমারসিবল বসানো হয়েছে তার সঙ্গে এগুলো যোগ হলে পানির সমস্যা অনেকটা দূর হবে বলে আশা করছি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্রীষ্মকালেই মূলত সমস্যাটা বেশি হয়। বিশেষ করে গত ২-৩ বছর যাবত। এবার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। বর্ষাকালে কিন্তু পানির স্তর ৮-১০ ফুটের মধ্যে চলে আসে। তখন সব চাপকলই কাজ করে। এ বছর গরমের শুরু থেকেই পানি উঠছে না। সমস্যার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি আমরা। আশা করি খুব শিগগিরই এই সমস্যা সমাধানে বড় ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর