সীমান্তবর্তী নেত্রকোনার দুর্গাপুরও কলমাকান্দা উপজেলায় পাহাড়ি গ্রামগুলোতে শুকনো মৌসুমে পানির সংকট চরমে। এবারের তীব্র দাবদাহে সেই সংকট আরও বেড়েছে। পাহাড়ে প্রায় প্রতিটি ঘরে এখন বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার চলছে। পাহাড়ি ঝরনার ছড়ার পানি ও পুকুরের ঘোলা পানিই এখন একমাত্র ভরসা।
দুর্গাপুর উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে দুর্গাপুর সদর ইউনিয়ন ও কুল্লাগড়া ইউনিয়ন ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা পাহাড়ি অঞ্চল। সেখানকার ১০ থেকে ১২টি গ্রামে ও কলমাকান্দা উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের রং ছাতি, কারনইও লেঙ্গুর ইউনিয়নের প্রায় ৩০ টি গ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। বসবাসকারী নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর জনগণ সুপেয় পানির জন্য সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সদর ইউনিয়নের গোপাল পুর,ভবানীপুর,ফান্দা,বারমারী,ভরতপুর,গাজিকোনা গ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় শুকনো মৌসুমে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে সাধারণ নলকূপ দিয়ে পানি আসে না। এজন্য তাঁরা বাধ্য হয়ে পুকুর বা পাহাড়ি ছড়ার পানি খেতে হয়। আর এতে পেটের অসুখ,চর্ম রোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। ওই গ্রামগুলোতে দিন আনে দিন খায় এমন হতদরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি থাকায় তাদের পক্ষে গভীর নলকূপ বসানো কিংবা গভীর কুয়া তৈরি করা সম্ভব নয়। গ্রামে দু-একজন অধিক অর্থ ব্যয় করে সাবমারসিবল বসালেও বেশিরভাগ মানুষের ভাগ্যে জুটছে না বিশুদ্ধ পানি।
এদিকে গত কয়েক বছর ধরে পানি পেতে হতদরিদ্র পরিবারগুলো তিন চাকের রিং বসিয়ে অগভীর কুয়া তৈরি করে খাবার পানি সংগ্রহ করলেও শুকনো মৌসুমে সেখানে পানি থাকে না। কোনো কোনোটাই পানি থাকলে সেটা খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। একটু ভালো পানির আশা করলেও দূরদূরান্ত থেকে কাঁধে করে বয়ে এনে পান করতে হয়।
গ্রামগুলোতে গিয়ে বিশুদ্ধ পানির অভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবারগুলো জানায়, তাদের পানির খুবই কষ্ট করতে হচ্ছে। পাহাড়ি ছড়ার পানি আর পুকুরের ঘোলা পানিই এখন খেতে হচ্ছে। তাও দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। সরকারিভাবেও কোনোরকম সহযোগিতা পাচ্ছে না তারা।
দুর্গাপুর সদর ইউনিয়নের ভরতপুর গ্রামের আদিবাসী নারী বুবু মারাক। তিনি দরিদ্র মানুষ। তাঁর বাড়িতে নলকূপ না থাকায় পানির জন্য সারা বছরই কষ্ট করতে হয়। তিনি বলেন,আমরার কল (টিউবওয়েল) নাই। আমরা অনেক আগে থেকে পাহাড়ের ঝরনার যে ছড়ার পানি আছে ওটাই খাই। রান্নাবান্নাসহ সব কাজ করি। খালি আমি না সবারই এই অবস্থা।
বারোমারি গ্রামের হারিজ উদ্দিন বলেন, আমার বাড়িতে একটি নলকূপ আছে। কিন্তু তাতে পানি আসে না। বাধ্য হয়ে প্রতিদিন পুকুরের পানি ছাঁকনি করে তা দিয়েই রান্নাবান্না,খাবারসহ সব চলে। পানির জন্য খুবই কষ্ট করতে হচ্ছে।
স্থানীয় পল্লি চিকিৎসক রেগুলার মানকিন বলেন, আমাদের পানির খুবই অভাব। পাহাড়ি ছড়ায় গর্ত করে সে জায়গা থেকেই পানি সংগ্রহ করি সবাই। কিন্তু এই পানি বিশুদ্ধ না হওয়ার নানারকমের রোগের দেখা দেয় সবসময়ই। আমাদের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি আমি।
সদর ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য রীতা নকরেক বলেন, আমাদের গ্রামে পানির তীব্র সংকট। পানির অভাবে গোসল, রান্নাবান্না কাপড় চোপড় পরিষ্কারসহ নিত্যদিনের কাজে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। একদিকে যেমন পানির অভাব অন্যদিকে এবারের তীব্র গরমের কারণে পাহাড়ি ছড়া বা পুকুরের পানি দিনের বেলায় অনেক গরম হয়ে থাকায় রাতে আনতে হয় সবার। সরকারিভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হলে এলাকার মানুষের উপকার হতো।
দুর্গাপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলাম বলেন, সীমান্তবর্তী আদিবাসী গ্রামগুলোতে গভীর টিউবওয়েল বসাতে হলে পাথর সরিয়ে প্রায় চার থেকে পাঁচ'শ ফুট নিচে পর্যন্ত যেতে হয়। তার জন্য ব্যয়বহুল খরচ যা সেখানকার মানুষের কষ্টসাধ্য। তবে বিকল্প হিসেবে গভীর রিং টিউবওয়েল বসানো যায় তাহলে আদিবাসীদের সুপেয় পানির সমস্যা কিছুটা দূর হবে।
এ ব্যাপারে দুর্গাপুর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ আশরাফুজ্জামান বলেন,পাহাড়ি এলাকায় পাথরের জন্য গভীর নলকূপ বসানো সম্ভব হয় না। পাহাড়ি এলাকায় পানি সংকট নিরসনে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা এই পানির সংকট দূর করতে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করতে চাচ্ছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানিয়েছি।
নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক জনাব, সাহেদ পাভেজ বলেন, পাহাড়ি এলাকার সাধারণ মানুষের সুপ্রিয় পানির জন্য অতি দ্রুত একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।
এই বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল এর মাধ্যমে একটি সার্ভে করা হচ্ছে। সার্ভে হয়ে গেলেই এলাকায় অনুযায়ী সুপেয় পানি ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে কাজ করবে, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে বিভিন্ন এনজিওদের সমন্বয়ে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। পাহাড়ি এলাকায় বাড়ির তীব্র সংকটের জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রকল্প নেওয়া হবে।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর