২৬ এপ্রিল জয়পুরহাটের ঐতিহাসিক ‘কড়ই-কাদিপুর গণহত্যা দিবস’ হলেও স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও তা উপেক্ষিত। এ দিনের স্মৃতি ধারণ করে এখানে এসে স্বজন হারানোরা চোখের জল ঝড়ালেও শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা যেন শুধু মাত্র শহিদ পরিবারের সদস্যদেরই দায়। আর কারও কিছু যায় আসেনা। নেই কোন দলীয় বা সরকারি প্রোগ্রাম, এগিয়ে আসেনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী কোন সংগঠন। স্থানীয় ’সৃজনী’ নামে একটি মাত্র সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন স্বল্প সংখ্যক লোকজন নিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ফুলেল শ্রদ্ধা জানান এবং স্মরণসভা আয়োজন করেন। এছাড়া বাবা-মা, ভাইসহ আত্মীয়স্বজন হারানো পরিবারগুলোর সদস্যরা বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে, মোম ও দেয়ার বাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন। অবস্থা দেখে মনে হয় এটা তাদেরই দায়। আর কারো কিছু যায় আসেনা।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ২৬ এপ্রিল (১৪ বৈশাখ) সোমবার জেলা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরত্বে সদর উপজেলার কড়ই ও কাদিপুর গ্রাম দু’টিতে তৎকালীন স্বাধীনতা বিরোধী মৌলবাদীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাকসেনারা মধ্যযুগীয় কায়দায় নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল ৩৭১ জন নিরীহ হিন্দু ধর্মাবলম্বী গ্রামবাসীকে। নিহতদের অধিকাংশই মৃৎ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। লুটপাট করা হয়েছিল তাদের টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ। দখল করা হয়েছে জায়গা-জমি, বসত বাড়িও। এলাকাবাসীর দীর্ঘ দিনের দাবির প্রেক্ষিতে এই বধ্যভূমিতে স্থানীয় জেলা পরিষদের উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও এ নৃশংস ও বর্বর গণহত্যার সঙ্গে জড়িত স্থানীয় দোসরদের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন শহিদ পরিবারের সদস্যরা।
শহিদ পরিবার এগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী স্বজনরা জানান, ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল রাতে কড়ই-কাদিরপুরের পাশে হানাইল, বম্বু গ্রামে মওলানা মোসলেম উদ্দিনের বাড়িতে একটি ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে যোগ দেন কড়ই গ্রামের মওলানা জসিম উদ্দিন ও মওলানা আব্দুল মান্নান। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় কড়ই-কাদিপুর গ্রাম দু’টিতে পরের দিন (২৬ এপ্রিল) অপারেশন চালনো হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৬ এপ্রিল সকালেই পাকসেনারা মওলানা মোসলেম উদ্দিনের বাড়িতে নাস্তা করার সময় আশ-পাশের হানাইল-বম্বু, সগুনা, বামনপুর, হেলকুন্ডা, ছোট হেলকুন্ডা, মীরগ্রাম, মুরারীপুর, হিচমী গ্রামের লোকজন পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে দিতে কড়ই-কাদিরপুর গ্রাম দু’টি ঘেরাও করে। এ সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা ফাঁকা গুলি বর্ষণ করলে ভীত সন্ত্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন প্রাণ ভয়ে ছুটোছুটি করতে থাকে।
মওলানা জসিম উদ্দিন তখন তাদেরকে মারা হবেনা এই মর্মে আশ্বাস দিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে দিতে মাঠের মধ্যে জড়ো হতে বলেন। এরপর ছয় পাকসেনা তিনভাগে ভাগ হয়ে লাইন করে গুলি চালায়। মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টার অপারেশনে ৩৭১ জনকে হত্যা করা হয় এখানে। এ ঘটনায় অনেকের মৃত্যু হলেও আধা মৃত অবস্থায় অনেকে বাঁচার জন্য আকুতি-মিনতি করতে থাকেন, কেউ পানি পানি করে চিৎকার করতে থাকেন। স্থানীয় সহযোগী রাজাকাররা এ সময় পানির বদলে প্রস্রাব খেতে দেয়। এতেই ক্ষান্ত নয় মৃতদের সাথে আধা মৃতদেরও বিভিন্ন স্থানে করা গর্তে মাটি চাপা দেয়া হয়। কড়ই-কাদিরপুর গ্রামে ৩ শ ৬৬ মৃৎ শিল্পী পরিবারের সঙ্গে হিন্দু- ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারও ছিল। এ নৃশংস গণহত্যার পরে দু/একটি পরিবার থাকলেও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর তারাও নানা হুমকি ধুমকিতে প্রাণ ভয়ে ভিটে-মাটি ছেড়ে পালিয়ে যান। তাদের প্রায় ৯ শ বিঘা জমি দখলে নেয় স্বাধীনতা বিরোধী স্থানীয় দোসড়রা।
জয়পুরহাটের ‘কড়ই-কাদিরপুর গণহত্যা দিবস উপলক্ষ্যে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও স্থানীয় শিক্ষা , সাংস্কৃতিক- সামাজিক সংগঠন ”সৃজনী’র উদ্যোগে শহিদদের স্মরণে স্মরণসভা ও ‘কড়ই-কাদিরপুর বধ্যভূমিতে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয় । সৃজনী’র প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান চেয়ারম্যান বৈশিষ্ট্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ম, নূরুন্নবী স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন।
বক্তব্য রাখেন- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট জয়পুরহাট শাখার সভাপতি আহমেদ মোশারফ নাননু, জয়পুরহাট সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক শাহাদুল ইসলাম সাজু, সৃজনীর সদস্য সানোয়ার হোসেন, কৃষিবিদ রেজাউল ইসলাম, এমদাদুল হক, শহিদ পরিবারের পক্ষ থেকে নারায়না দেবনাথ প্রমুখ।
ওই হত্যাযজ্ঞে স্বজন হারানোরা দাবি করে বলেন, জীবিত থাকতেই পিতামাতার হত্যাকারীদের বিচার দেখে যেতে পারলে আত্মা শান্তি পেতো। স্বামী সুবল চন্দ্রকে হারানোর বেদনা আজও বুকে লালন করছেন স্ত্রী সুধা রানি তিনি সেদিনের নৃশংসতার কথা বলতে গিয়ে আজও আঁৎতে ওঠেন এবং চোখ জল জল করে ওঠে। স্বজন হারানো লোকজন এখনো গণহত্যার স্মৃতিচিহ্ন বুকে ধারণ করে বিচারের আশায় দিন গুনছেন। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও এ নৃশংস ও বর্বর গণহত্যার বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে শহিদ পরিবারের স্বজনরা বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিচার হবে এমন প্রত্যাশা তাদের। উল্লেখ্য, সেই সময় স্থানীয়ভাবে গঠিত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন বিএনপি নেতা আব্দুল আলিম (পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীর দায়ে সাজা প্রাপ্ত হয়ে মৃত)। ১৯৭১ সালের জয়পুরহাটে রাজাকার আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাক সেনাদের গণহত্যা চালানোর পেছন থেকে নেতৃত্ব দেন আব্দুল আলিম।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর