
খুলনার কয়রা উপজেলার বেদকাশী কলেজিয়েট স্কুলের অধ্যক্ষ আব্দুল মাজেদের বিরুদ্ধে জাল সনদে চাকরি, অনিয়ম ও আর্থিক সুবিধার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ, বিদেশে থাকা শিক্ষকের বেতন উত্তোলনে সহায়তার সত্যতা মিললেও স্বপদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
সম্প্রতি অভিভাবক-এলাকাবাসী, শিক্ষার্থী-সাবেক শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে দুর্নীতি দমন কমিশন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ কয়েকটি দপ্তরে লিখিত অভিযোগের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন।
অভিযোগ উঠেছে, এর পর অধ্যক্ষের এসব অনিয়ম-দুর্নীতি ধামা চাপা দিতে অভিযোগকারীদের কয়েকজনকে টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করা হয়েছে। অধ্যক্ষ আব্দুল মাজেদ প্রভাষক মোস্তাফিফুর রহমানের সহায়তায় অভিযোগকারী কয়েকজনকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেন। যার একটি অডিও ক্লিপ এলাকাবাসীর মোবাইলে মোবাইলে ঘুরছে। একইসাথে অভিযোগকারী কয়েকজনের স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে।
অভিযোগকারীদের একজন উত্তর বেদকাশির বাসিন্দা মাহফুজুল ইসলাম বলেন, বেদকাশী কলেজিয়েট স্কুলের অধ্যক্ষ ও দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও লিখিত অভিযোগের পর কে বা কারা আমার স্বাক্ষর নকল করে অভিযোগ প্রত্যাহার করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দিয়েছে তা আমি জানি না। আমি এই জালিয়াতির ঘটনার সাথে যারা জড়িত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, যোগদানের পর থেকেই অধ্যক্ষ আব্দুল মাজেদ বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে নিজের আখের গোছানোর চেষ্টা করেন। তিনি অনুগত শিক্ষক ও দলীয় লোকদের নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্টানটিতে গড়ে তুলেছেন একটি সিন্ডিকেট। তার একক মনগড়া সিদ্ধান্ত, অদূরদর্শিত ও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি এখন সংকটে। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি সরকারদলীয় লোক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের 'ম্যানেজ' করে বহালতবিয়াতে রয়েছেন। স্কুল ও কলেজ শাখায় প্রায় ১৫ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
২০২১ সালে কম্পিউটার ল্যাব অ্যাসিস্টেন্ট পদে নিয়ম বহির্ভূতভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়ে আইয়ুব আলী নামের একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে মোস্তাফিজুর রহমান নামে একজনকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে নিয়োগের পর ২০১৭ সালে তিনি কোরিয়া চলে যান। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হওয়ার ঘোষণা আসার পর দেশে ফিরে পুনরায় তিনি অধ্যক্ষকে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে চাকরিতে যোগ দেন। এমনকি বিদেশে থাকাকালীন সময়েও তিনি বেতন-ভাতা গ্রহণ করেন।
এ ব্যাপারে মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হলে আর্থিক লেনদেনের বিষয় অস্বীকার করে এমপিওভুক্তির আগেই তিনি দেশে ফিরেছেন এবং প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী বেতন-ভাতা উত্তোলন করেছেন বলে দাবি করেন।
অভিযোগ সূত্রে আরও জানা যায়, অধ্যক্ষের নিজের শিক্ষাসনদগুলোও জাল। তিনি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সার্টিফিকেট জমা দিয়েছেন তা ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়নি। তার শিক্ষা অভিজ্ঞতার সনদও জাল। এসব বিষয়ে আবু ইছা গাজী নামের স্থানীয় একজন অভিভাবক সদস্য অধ্যক্ষ আব্দুল মাজেদের নামে মামলা করেন। এছাড়া অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে হাজিরা খাতায় অগ্রিম স্বাক্ষর, কলেজে অনুপস্থিত থাকা, স্কুলের মাঠ একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে লিজ দেওয়া, শিক্ষিকা মাহফুজা খানমকে মাতৃত্বকালীন ছুটির আড়ালে অন্যত্র চাকরির সুযোগ করে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
সহকারী শিক্ষক গোপাল চন্দ্র মন্ডল বলেন, অধ্যক্ষ কাউকে তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছামাফিক নানা অনিয়ম- দুর্নীতি করেছেন। প্রতিবাদ করলেই পড়তে হয় বিপদে। অধ্যক্ষের এসব অবৈধ কাজে বাধা দেওয়ায় আমার টাইমস্কেল আটকে রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে একাধিক তদন্ত হলেও কোন লাভ হয়নি। তিনি সবাইকে ম্যানেজ করে নেন।
তবে সার্বিক বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ আব্দুল মাজেদ দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সঠিক নয়। তিনি বলেন, কারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলো, কারা অভিযোগ তুলে নিয়েছে এসব আমার জানা নেই। তবে কাজ করতে গেলে ছোটখাটো ভুল হতেই পারে।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ আসার পর ইউএনও স্যার আমাকে তদন্তের দায়িত্বে দেন। আমি তদন্তের প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। তদন্তে সত্যতাতাও মিলেছে। বাকিটা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কী ব্যবস্থা নিবেন তারাই সেটা ভাল বলতেন পারবেন।
বিষয়টি জানতে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলি বিশ্বাসকে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলোও কোন সাড়া দেননি। দপ্তরে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ শামছুল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে ব্যস্ততার অজুহাতে বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যান তিনি।
খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, এ ব্যাপারে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণাদী পেলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর