
শেষ ঠিকানার কারিগর মনু মিয়া। পরম দরদ আর অপার ভালোবাসা দিয়ে তিনি সাজান মুসলিম সমপ্রদায়ের শেষ ঠিকানা-কবর। কারও মৃত্যু সংবাদ কানে আসামাত্রই খুন্তি, কোদাল, ছুরি, করাত, দা, ছেনিসহ সহায়ক সব যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটে যান কবরস্থানে মানুষের অন্তিম যাত্রায় তিনি বাড়িয়ে দেন তার আন্তরিক দু’হাত। এভাবেই কবর খননের কাজ করে তিনি পার করে দিয়েছেন তার ৬৭ বছরের জীবনের সুদীর্ঘ ৪৯টি বছর। কোনো ধরনের পারিশ্রমিক কিংবা বখশিস না নিয়ে এ পর্যন্ত খনন করেছেন ৩ হাজার ৫৭টি কবর।
ব্যতিক্রমী পন্থায় মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ সেবাপরায়ণতার এক অনন্য প্রতীক মনু মিয়া কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর উপজেলা ইটনার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। দূরের যাত্রায় দ্রুত পৌঁছাতে নিজের ধানীজমি বিক্রি করে বেশ কয়েক বছর আগে কিনেছেন একটি ঘোড়া। এই ঘোড়ার পিঠে তিনি তুলে নেন তার যাবতীয় হাতিয়ার-যন্ত্র। সেই ঘোড়ায় সওয়ার হয়েই শেষ ঠিকানা সাজাতে মনু মিয়া ছুটে চলেন গ্রাম থেকে গ্রামে।
ঘোড়াটিই যেন তার বয়সের বাধা অতিক্রম করে দিয়ে তাকে সচল রেখে চলেছিল। জীবনভর এ কাজটি করতে গিয়ে নিজের দিকেই খেয়াল নেয়া হয়নি তার। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা জটিল রোগ। রোগে কাবু হয়ে সম্প্রতি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি। এ রকম পরিস্থিতিতে গত ১৪ই মে তাকে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই এক রকম মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসা চলছে নিঃসন্তান মানুষটির। স্ত্রী রহিমা বেগম জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা স্বামীর পাশে রয়েছেন ছায়ার মতো।
মনু মিয়ার এমন সংকটকালেই বর্বরতার বলি হয়েছে তার প্রিয় ঘোড়াটি। বাড়িতে মনু মিয়া ও তার স্ত্রী রহিমা বেগমের অনুপস্থিতিতে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে ঘোড়াটি। তিনদিন ধরে গ্রামবাসী কারও নজরে পড়েনি ঘোড়াটি।
শুক্রবার (১৬ মে) সকালে পার্শ্ববর্তী মিঠামইন উপজেলার কাটখাল ইউনিয়নের হাশিমপুর ছত্রিশগ্রাম থেকে গ্রামবাসীর কাছে একটি ফোনকলে আসে দুঃসংবাদটি। হাশিমপুর ছত্রিশ গ্রামের একটি মাদ্রাসার পাশের জমির পানির মধ্যে ঘোড়াটি মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান আলগাপাড়া গ্রামের তিন তরুণ-যুবক। তারা গিয়ে মৃত ঘোড়াটিকে দেখে হতবিহ্বল হয়ে যান। বুকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে মনু মিয়ার প্রিয় ঘোড়াটি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মনু মিয়ার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার কথা ভেবে স্ত্রী ও স্বজনেরা তার কাছে গোপন রেখেছেন নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া তার ঘোড়াটির কথা।
মোবাইল ফোনে মনু মিয়ার স্ত্রী রহিমা বেগম এ প্রতিবেদককে বলেন, উনার অবস্থা ভালো না। একমাত্র আল্লাহ্ পাকের রহমতেই উনি সুস্থ হতে পারেন। উনি জীবনে কারও কোনো ক্ষতি করেননি। এতোদিন জানতাম, উনাকে মানুষ ভালোবাসে। উনার এমন খারাপ অবস্থায় কী করে এমনভাবে উনার প্রিয় ঘোড়াটিকে মানুষ মেরে ফেলতে পারলো! এই খবরটা আমরা উনাকে দিলে উনি কোনোভাবেই সহ্য করতে পারবেন না।
এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপারের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মুকিত সরকার জানান, বিষয়টির খোঁজখবর নিয়ে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেবেন।
মনু মিয়ার প্রিয় ঘোড়াটিকে মানুষ মেরে ফেলার খবর ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় প্রতিবাদ এর ঝড়।
কিশোরগঞ্জ সেন্ট্রাল প্রেসক্লাব এর সভাপতি আশরাফুল ইসলাম এর নিজস্ব ফেসবুক আইডিতে প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেন, "মানুষ এমন দানব আর নির্দয়ও হতে পারে! এই ঘোড়াটিতে চড়ে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের শেষ ঠিকানার কারিগর মনু মিয়া দূর-দূরান্তে কবর খুঁড়তে যেতেন। মনু মিয়া অসুস্থ হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন। এই সুযোগে ঘোড়াটিকে কিছু অমানুষ মেরে ফেলেছে। আজকে মৃত অবস্থায় ঘোড়াটিকে মিঠামইন উপজেলার কাটখাল ইউনিয়নের হাসিমপুর গ্রামে পাওয়া গেছে। এ ঘটনার সাথে জড়িতদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।"
এস. এইস. জীবন নামের আরেক ফেসবুক আইডিতে প্রতিবাদ পোস্টে লিখেন, "মনু চাচার অপরাধ কি? তার ঘোড়ার অপরাধ কি? মৃত্যুর পর একটা মানুষের শেষ ঠিকানা কবর খুঁড়ে দেওয়া কি তার অপরাধ? মনু মিয়া অসুস্থ, ঢাকায় চিকিৎসাধীন। তার সঙ্গী ঘোড়া বাড়িতে ছিল। কে বা কারা তার সেই সঙ্গী ঘোড়াকে মেরে ফেলেছে। দ্রুত দোষীদের গ্রেফতার দাবি করছি। সুস্থতা কামনা করছি মনু চাচার।"
এমনভাবে আরো অনেকেই তাদের নিজস্ব ফেসবুক আইডিতে প্রতিবাদ পোস্ট দিয়েছে। এবং তাদের পোস্টে লিখেছেন, এমন ন্যাক্কারজনক ঘঠনার সাথে যারা জড়িত তদন্ত করে দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং এর বিচার করতে হবে।
আরমান/সাএ
সর্বশেষ খবর