
নেত্রকোনা সীমান্ত এলাকা কলমাকান্দায় সংরক্ষিত বনে পাহাড় ও গাছ কেটে সড়ক নির্মাণে অভিযোগ উঠেছে। গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ওই কর্মযজ্ঞ চললেও স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর কোন পদক্ষেপ দেয়নি।
তবে বন বিভাগের লোকজন বাধা দিতে গেলে উলটো তাদের গালমন্দ করে হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে লেংগুরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির যুগ্মাহ্বায়ক মো. সাইদুর রহমান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে। অবশ্য চেয়ারম্যানের দাবি তিনি কোন গালাগাল বা হুমকি দেননি। আর পাহাড় বা গাছ কাটেননি।
স্থানীয় বাসিন্দা ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সীমান্তবর্তী কাঁঠালবাড়ি সড়ক নির্মাণের জন্য কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচির আওতায় ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় উপজেলা প্রশাসন।
কাঁঠালবাড়ি সুবেন ঘাঘড়ার টিলা হতে চৈতানগর মহসিন মেম্বারের বাড়ি পর্যন্ত অন্তত এক কিলোমিটার ১.১২৪ মিটার ওই সড়ক নির্মাণকাজ গত ৭ দিন ধরে শুরু হয়েছে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বেকার, দরিদ্র, ভূমিহীনদের দিয়ে মাটি কাটার কাজটি না করিয়ে অধিক লাভের আশায় নিজে ভেকু মেশিন দিয়ে কাজটি বাস্তবায়ন করছেন।
অভিযোগ রয়েছে, পাহাড়ি এই সড়কটি দিয়ে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত চার চাকার গাড়ি যেতে ১২ ফুট প্রশস্ত করা হচ্ছে। সড়ক প্রশস্ত করতে গিয়ে প্রায় ৪৫০ মিটার অংশের দুপাশে পাহাড় কেটে মাটি ফেলা হয়েছে। এছাড়া ভেকু দিয়ে রাস্তার পাশে বনের অন্তত ১৮টি বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাঝারি গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছে।
কিন্তু এ ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসন কোন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তবে বন বিভাগ বাধা দিতে গেলে চেয়ারম্যান অকথ্য গালিগালাজ করে তাড়িয়ে দেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, জোরা মন্দির টিলাসংলগ্ন খেতের এলাকায় ভেটু দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে।
কাজ দেখার দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাই মো. মারুফ বলেন, ‘অর্ধেকের বেশি অংশ কাজ হয়ে গেছে। আর তিন দিনের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে।’ সামনে এগিয়ে দেখা গেছে সড়কের দুই পাশে পাহাড় থেকে মাটি কেটে রাস্তায় দেয়া হয়েছে। সুবেনের টিলার কাছে ১৮টি আকাশি প্রজাতির গাছ ভেকু দিয়ে উপড়ে ও ভেঙে ফেলে রাখা হয়েছে।
পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ওই এলাকার ষাটোর্ধ্ব একজন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বাসিন্দা বলেন, রাস্তাটা আমাদের দরকার। কিন্তু পাহাড় বা গাছ কাটাটা ঠিক হইছে না। এইডা পরিবেশ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হইবো। পাহাড় কাটায় বর্ষাকালে বিপজ্জনক হইতে পারে। আরেকটু এগিয়ে সীমান্ত পিলার এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে ১৪ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের লোকজন বসে আছেন। তাঁদের মধ্যে চারজন নারী রয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই এলাকার অন্তত আটজন বাসিন্দা জানান, কাঠাঁলবাড়ি এলাকাটি চোরাকারবারিদের নিরাপদ রোড হিসেবে ব্যবহার করে। ওই পথে অবাধে ভারতীয় চিনি, নেশা জাতীয় দ্রব্য, প্রসাধনী, সুপারি, ব্লেটসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য পাচার করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি চোরাকারবারিদের নেতৃত্ব দেন।
লেংগুরা বন বিটের পাহাড়াদার মো. আখতারুল ইসলাম বলেন, ‘পাহাড়ে রাস্তা করতে গিয়ে সংরক্ষিত বনের চৈতানগর কাঠাঁলবাড়ি মৌজার ২৩২ নম্বর দাগের ২০টির মতো গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। আমি উপস্থিত হয়ে বাধা দিতে গেলে ইউপি চেয়ারম্যান এসে অকথ্য-অশ্রব্য ভাষায় আমাকে গালিগালাজ করাসহ হুমকি ও ভয়-ভীতি দেখান। আমি এখন আতঙ্কে আছি। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’
বন বিভাগের দুর্গাপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মজুনু প্রামাণিক মুঠোফোনে বলেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যানের নির্দেশে বনের গাছ কাটা হয়েছে। বাধা দিতে গেলে তিনি আমাদের লোকজনের সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করেছেন। এ ব্যাপারে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিব।’
চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘রাস্তাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি নির্মাণে কোন পাহাড় বা গাছ কাটা হয়নি। এসব গাছ ঝড়ে পড়ে থাকতে পারে। আর বন বিভাগের কাউকে গালাগাল বা হুমকি দেয়া হয়নি। ভেকু দিয়ে মাটি না কাটলে দ্রুত রাস্তা হবে না।’
পরিবেশ অধিদপ্তর নেত্রকোনা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল মতিন বলেন,কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জাতীয় স্বার্থের বাইরে পাহাড় বা টিলা কাটতে পারবে না। জাতীয় স্বার্থেও পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া কাটলে ২ বছরের জেল, ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। বা ১০ বছরের জেল, ১০ লাখ টাকা জরিমানাসহ উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। "
পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ হতে ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়েছে এবং সাম্প্রতিক দৃশ্যমান পাহাড়/ টিলা কর্তন/ মোচনের সত্যতা পাওয়া গিয়েছে। উক্ত বিষয়ে এনফোর্সমেন্ট মামলা চলমান রয়েছে।"
কলমাকান্দার ইউএনও ফাইযুল ওয়াসীমা নাহাত বলেন, ‘পাহাড় বা গাছ কেটে রাস্তা নির্মাণের বিষয়টি আমার জানা ছিল না। বন বিভাগের লোকজন মুঠোফোনে তা জানিয়েছেন। তবে চেয়ারম্যান তা অস্বীকার করেছেন। এমন হয়ে থাকলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, পুরোনো রাস্তায় সংস্কার কাজ হচ্ছে, পাহাড় বা গাছ কাটার বিষয়টি আমি সরজমিনে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করব।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর