
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির পক্ষ থেকে আজ ২৩ মে ২০২৫ শুক্রবার সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তৃতীয় তলায় মাওলানা আকরাম খান মিলনায়তনে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে কেমন বাজেট চাই?' সভার আয়োজন করা হয়েছে।
সভায় বিগত বাজেট নিয়ে পর্যালোচনা এবং আসন্ন বাজেট নিয়ে নানান প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন আলোচকরা। উক্ত আলোচনা সভায় আলোচনা করেছেন, কৃষি বাজেট- মাহা মির্জা, শিক্ষক ও গবেষক। সংস্কৃতি বাজেট- সজীব তানভীর, স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা। জ্বালানি বাজেট- মোশাহিদা সুলতানা ঋতু, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষা বাজেট- সালমান সিদ্দিক, প্রেসিডেন্ট, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। গত দেড় দশকের বাজেটের যেসব প্রবণতা থেকে বের হতে হবে- মাহতাব উদ্দিন আহমেদ, লেখক ও গবেষক। চিকিৎসা বাজেট- ড: হারুন উর রশীদ, চিকিৎসক এবং প্রাক্তন অধ্যাপক, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ। শ্রীলঙ্কা থেকে কি শিখলাম- কৌশিক আহমেদ, লেখক। বাজেটে বৈষম্য ও সামাজিক নিরাপত্তা - কল্লোল মোস্তফা, লেখক ও গবেষক। জেন্ডার বাজেট- মারজিয়া প্রভা, অ্যাক্টিভিসস্ট।
শিক্ষক ও গবেষক মাহা মির্জা বলেন দেশের মোট বাজেট ৭ লক্ষ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে কৃষি ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বাজেট একত্র করলে দাঁড়ায় ৩১ হাজার ৫০০ কোটি। অর্থাৎ কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাতের বাজেট দেশের মোট বাজেটের মাত্র ৪ শতাংশ। অথচ এই খাতেই সবচেয়ে দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরী হয়ে থাকে (প্রায় ৪০ শতাংশ)।
তিনি বলেন, সার, বীজ, ডিজেল সহ কৃষি উপকরণের দাম বেড়েই চলেছে। এতে করে কৃষকের উৎপাদন খরচ ক্রমাগত বাড়ছে এবং ফসল উৎপাদন করে কৃষক টিকতে পারছেনা। তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএডিসির বীজের সরবরাহ বাড়ানোর সুপারিশ করেন। এছাড়াও তিনি কৃষি খাতের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে ৫টি সুপারিশ করেন।
“গত দেড় দশকের বাজেটের যেসব প্রবণতা থেকে বের হতে হবে” শীর্ষক আলোচনায় লেখক ও গবেষক মাহতাব উদ্দিন আহমেদ দেখিয়েছেন গত ১৫ বছরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন, কৃষি, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের সাথে তুলনা করলে জনপ্রশাসন খাতের ব্যয় ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেছেন জনগণের ট্যাক্সের টাকায় আমলা ও সচিবদের বরাদ্দ ক্রমাগত বেড়েছে যেইটা কাম্য নয়। তিনি আরো দেখিয়েছেন গত ১৫ বছরে পরিবেশ ধ্বংসকারী প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১ লক্ষ ১৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের গত ১৫ বছরের বাজেট ১৮ হাজার কোটি টাকা।
জ্বালানি বাজেট নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতু বলেছেন, ‘ক্ষমতাচ্যুত সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বাজেটে আমদানিতে ব্যয় বেশি এবং দেশীয় গ্যাস উৎপাদনকে অবহেলা করা হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল, চার বছর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
তিনি আরও সুপারিশ দেন যে, “নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মানে ব্যয় না করে দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে বিনিয়োগ করতে হবে, স্থলে ও সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনের জন্য বাপেক্সের সক্ষমতা তৈরি করতে বাজেট বরাদ্দ করতে হবে, বিদেশী কোম্পানিকে দিয়ে গ্যাস উত্তোলন থেকে বিরত থাকতে হবে, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাজেট বরাদ করতে হবে, এলপিজিতে ভর্তুকি দিতে হবে এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি একীভূতকরণের লক্ষ্যে বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে”।
বৈষম্য ও সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ে লেখক ও গবেষক কল্লোল মোস্তফা বলেন যে, “বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা বৈষম্যমূলক। সরকার ধনীদের কাছ থেকে তাদের আয় ও মুনাফার ওপর কর আদায়ে জোর না দিয়ে জোর দেয় দরিদ্র-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছ থেকে ভ্যাট ও শুল্কের মতো পরোক্ষ কর আদায়ে, যা দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। দেশে বছরে ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকার আয়কর ছাড় দেওয়া হয় যার মধ্যে প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ৬৮ শতাংশ করছাড় দেওয়া হয়। বিভিন্ন খাতে কর ফাঁকি ও কর এড়িয়ে যাওয়ার কারণে বছরে ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি থেকে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব আয় কম হয়।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংকট ও উত্তরণের পথ প্রসঙ্গে চিকিৎসক অধ্যাপক ড: হারুন-উর-রশীদ ১৬টি করণীয় চিহ্নিত করেন। এর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যকে জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, গণমুখী স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, ১৯৮২ সালে ঘোষিত ঔষধনীতির মূল কাঠামো ও লক্ষ্য ঠিক রেখে হালনাগাদকরণ ও বাস্তবায়ন, সরকারি হাসপাতালে ইউজার ফি বাতিল, স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বৃদ্ধি করে (এখনই জাতীয় বাজেটের ৮% ও ক্রমান্বয়ে ১৫% এবং জিডিপির ২% ও ক্রমান্বয়ে ৫%) এ উন্নীতকরণ, উপজেলা পর্যায়ে সরকারি হাসপাতালসমূহ ১০০ শয্যা ও জেলা পর্যায়ে ২৫০ শয্যার উন্নীতকরণ।
শিক্ষা বাজেট নিয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের প্রেসিডেন্ট সালমান সিদ্দিক বলেন, ‘মোট জিডিপির ৬ ভাগ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখতে হবে। প্রাক প্রাথমিক শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত সাত কলেজ নিয়ে সম্প্রতি ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়' গঠিত হয়েছে। এরজন্য নতুন অবকাঠামো তৈরি, শিক্ষক নিয়োগসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য আসন্ন বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।
জেন্ডার বাজেট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে একটিভিস্ট মারজিয়া প্রভা বলেন যে, ‘রাষ্ট্রকে জেন্ডার বিষয়ক পরিস্কার ধারণা থাকতে হবে। এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্র নারীর জন্য বিশেষায়িত বাজেট বরাদ্দকে জেন্ডার বাজেট হিসেবে দেখাতে চাচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে কোন মন্ত্রণালয় কিভাবে তার প্রকল্পে নারীকে সুবিধাভোগীর জায়গায় রাখছে তা স্পষ্ট করতে হবে।
রাষ্ট্রকে বিগত বছর এবং সামনের অর্থবছর থেকে জেন্ডার বাজেট নিয়ে পরিপূর্ণ প্রতিবেদন জনগণের সম্মুখে তুলে ধরতে হবে। মন্ত্রণালয়গুলো কে কি জেন্ডার বাজেট এর বরাদ্দ কোন খাতে ব্যবহার করছে তা প্রকাশ্যে না আনলে জেন্ডার বাজেট ফ্রেমওয়ার্ক একটি অপ্রয়োজনীয় রেটোরিক হয়ে থাকবে। পাশাপাশি সামাজিক খাতে নারী ও হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য ভাতাকে নামমাত্রে দেওয়ার বদলে, তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রদান করতে হবে।
সংস্কৃতি বাজেট নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা সজীব তানভীর প্রস্তাব করেছেন যে, “সংস্কৃতি খাতকে একটি অলাভজনক খাত হিসেবে চিন্তা করার মানসিকতা পরিহার করতে হবে, প্রশাসন নির্ভর শিল্পচর্চা ব্যয় কমিয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠকদের মাধ্যমে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সংগঠনসমুহের মাধ্যমে নাটক, সঙীত, নৃত্য, আবৃত্তি, চারুকলা, ফটোগ্রাফি ইত্যাদি বিভিন্ন ক্যাটাগরির পরিবেশনা নির্মান ও প্রদর্শনের জন্য আর্থিক বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
শ্রীলংকা থেকে বাংলাদেশের শিক্ষণীয় যেসব বিষয় হতে পারে তা লেখক ও গবেষক কৌশিক আহমেদ উল্লেখ করেছেন যে, ‘এনপিপির মতো একটি নীতিনিষ্ঠ ও অংশগ্রহণমূলক জোট তৈরি করা, মানুষের অংশগ্রহণে ইশতেহার তৈরি করা যেখানে থাকবে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার, ধর্মনিরপেক্ষতা, পরিবেশ সচেতনতা ও লিঙ্গ সমতার নিশ্চয়তা, তাত্ত্বিক ভিত্তি শক্ত করা, ডিজিটাল স্পেসে তরুণদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন, প্রতীকি নয় সত্যিকার অন্তর্ভুক্তি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত যাতে নেতৃত্ব যেন জবাবদিহিতার বাইরে না থাকে, প্রার্থীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ ও মনোয়নে নৈতিক মানদন্ড বজায় থাকে”।
সভার শেষে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন “জুলাই থেকে জুন অর্থবছরটি ব্রিটিশ আমলে প্রচলিত অর্থবছর যা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়াসহ কিছু দেশে এখনও চলমান। কিন্ত বিভিন্ন দেশই তাদের নিজেদের প্রয়োজন ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে অর্থবছর পরিবর্তন করেছে। আমাদের দেশেও জুলাই থেকে জুনের বদলে বাংলা সাল বৈশাখ থেকে চৈত্র কিংবা জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরে অর্থবছর পরিবর্তন করা যায়।
সরকারের কাজ ছিল বৈষম্যবিহীন বাংলাদেশ নির্মাণের গতিমুখ ঠিক করা। এই সরকার অস্থায়ী সরকার, এর স্থায়ী কোন ম্যান্ডেট নেই। সুতরাং তার পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব না। কিন্তু সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট হয়েছে, কিছু সংস্কারের প্রত্যাশা রয়েছে এবং কিছু করণীয় আছে যেগুলো তারা খুব সহজেই করতে পারে।
যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি প্রাথমিক এবং বহু বছরের দাবি যা বর্তমানে মোট বাজেটের ৫-৬ ভাগ যা থাকা উচিত তা বরাদ্দ থাকে ১ থেকে ২ ভাগ, যা বিশ্বের সব দেশের চাইতে বাংলাদেশ সবচেয়ে নীচে। এই অর্থবছরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ করে তারা জনগণের স্বার্থে সংস্কারের কিছু নমুনার সূচনা করতে পারে।
পারে পরিমাণগত বৃদ্ধির পাশাপাশি গুণগত মানকেও বৃদ্ধি করতে। বরাদ্দকৃত অর্থে অপ্রয়োজনীয় খরচ ও প্রকল্প, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং দুর্নীতি আছে। এগুলো দূর করতে হলে পূর্ণাঙ্গ বাজেট খরচের খাতসহ জনগণের সামনে উন্মুক্ত করতে হবে।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর