
আকাশে মেঘ দেখলেই এখন উপকূলের মানুষের মনে জাগে উদ্বেগ। বৃষ্টি মানেই তাদের কাছে ঘরছাড়া হবার পূর্বাভাস। প্রতিবছরের বর্ষা যেন এক একটি ভয়াবহ স্মৃতি হয়ে আসে কক্সবাজারের উপকূলজুড়ে।
বিশেষ করে মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ, রামু, ও উখিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালার কারণে কক্সবাজার উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে দমকা হাওয়া ও মাঝারি বৃষ্টিপাত।
বৈরী আবহাওয়ার কারণে উত্তাল সাগর এবং জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনায় কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। কিন্তু সাগরের এই উত্তালতা এখন কেবল সাময়িক দুর্যোগ নয়- প্রতি ঢেউয়ের আঘাতে ধ্বংস হচ্ছে কক্সবাজারের উপকূলরেখা, বিলীন হচ্ছে জনপদ, আর সামনে আসছে বড় পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশঙ্কা।
কক্সবাজারের প্রধান সমুদ্রসৈকত ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলার উপকূলজুড়ে বহু স্থানে ভূখণ্ড সাগরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। শুধু গেল তিন বছরে প্রায় ৪০ কিলোমিটার সৈকত রেখা ও অন্তত ২০ একর কৃষিজমি ভাঙনের শিকার হয়েছে- এমন তথ্য জানিয়েছেন একাধিক সূত্র।
উপকূলীয় বাসিন্দা আব্দুল জলিল বলেন, “আমার বাবার ভিটা এখন সাগরের তলায়। আরও কয়েক বছর এইভাবে চললে হয়ত আমরাও আশ্রয়হীন হয়ে যাব।”
জানা গেছে, কক্সবাজারকে বলা হয় বাংলাদেশের ‘ট্যুরিজম ক্যাপিটাল’। অথচ এই পর্যটননির্ভর অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় বা নিম্নচাপের প্রাক প্রস্তুতি এখনো ঘটনার পরের প্রতিক্রিয়া নির্ভর। পর্যটকদের নিরাপত্তায় সৈকতের বালুচরে লাল পতাকা টাঙানো হলেও কার্যকরভাবে অনেকেই তা মানছেন না। পর্যাপ্ত লাইফগার্ড, মনিটরিং সিস্টেম কিংবা জরুরি উদ্ধার সরঞ্জামের অভাব এখানকার বড় দুর্বলতা।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, “আমরা সমুদ্রে নামা নিরুৎসাহিত করছি এবং পর্যটকদের নিরাপত্তায় কাজ করছি।” তবে বাস্তবতা হলো, সৈকতের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সীমিত জনবল ও সরঞ্জাম দিয়ে পুরো অঞ্চলকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়।
প্রতিবারই দুর্যোগ এলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংকেত জারি, মাইকিং বা সীমিত আশ্রয় প্রস্তুতি দেখা যায়। কিন্তু উপকূল রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ খুব কম। কক্সবাজারে ‘সৈকত ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ’ নামে কোনো স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান নেই। জেলাভিত্তিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিও কেবল কাগজে-কলমে সক্রিয়। এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
সচেতন মহলে বলছে, “প্রকল্প অনেক হয়, বরাদ্দও আসে, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় কম। অনেক সময় দুর্নীতি বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে প্রকল্প বাস্তব রূপ পায় না।”
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ দেখা যাচ্ছে উপকূল অঞ্চলে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সাগরের অগ্রগতি প্রতিবছর ১০ থেকে ২০ মিটার ভূমি গ্রাস করছে। গবেষণা বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে কক্সবাজার জেলার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সাগরের তলায় চলে যেতে পারে, যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়।
সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (CEGIS) এর তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজারের চারটি উপজেলা উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ভাঙনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের হাজারো পরিবার বাধ্য হচ্ছে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র সরে যেতে।
বহু মৎস্যজীবী এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে। পেশা হারিয়ে তারা অন্য জেলায় অভিবাসনের পথে পা বাড়াচ্ছেন। একইসঙ্গে মৎস্যজীবী নৌকাগুলো যেহেতু নিরাপদ ঘাট পায় না, ফলে সামান্য ঝড়েই ঘটে ক্ষয়ক্ষতি।
পরিবেশবিদ ও পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, উপকূল রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি ও বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক বাঁধ, ম্যাংগ্রোভ বন সম্প্রসারণ, এবং সাগররোধী বাঁধ নির্মাণ জরুরি। উপকূলীয় বাসিন্দাদের জন্য নিরাপদ পুনর্বাসন পরিকল্পনা গ্রহণ। পর্যটন ব্যবস্থাপনায় দুর্যোগ-সহনশীলতা অন্তর্ভুক্ত করা।
সচেতন মহলের দাবি, ‘ভাঙছে উপকূল কেবল আজকের বাস্তবতা নয়, বরং আগামী দিনের ভয়াবহ সংকেত। পর্যটননির্ভর এই জেলার ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় এখনই জরুরি সমন্বিত ও টেকসই পরিকল্পনা। তা না হলে সাগরের একেকটি ঢেউ শুধু ভূখণ্ডই নয়, মুছে দেবে জীবন, জীবিকা ও ইতিহাস।
মহেশখালীর বড়ছড়া এলাকার বাসিন্দা মো. ইউনুস (৫৫) বলেন, “বছর বছর শুধু দেখি পাড় ভাঙে, জমি হারাই। বর্ষার সময় মনে হয় ঘর ছেড়ে কোথায় যাব, সেটা ঠিক করেই থাকতে হয়।”
কুতুবদিয়ার লেমশিখালি এলাকার রাহেলা বেগম (৪৫) বলেন, “সন্ধ্যা হলে সাগরের গর্জনে ঘুম আসে না। বাঁধ নেই, সুরক্ষা নেই, শুধু ভয়। একটা বৃষ্টি হলেই পানি ঘরে ঢুকে পড়ে।”
ভাঙনের ফলে স্কুলগামী শিশুরা নিয়মিত শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়ছে। টেকনাফের বাহারছড়া এলাকার শিক্ষক আজিজুর রহমান জানান, “বর্ষা মৌসুমে শিক্ষার্থী উপস্থিতি অর্ধেকে নেমে আসে। কেউ বাড়ি বদলায়, কেউ ভয়েই আসতে পারে না।”
রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ির ইউনিয়নের পশ্চিম উমখালীর বাসিন্দা আবু তাহের (৬৫) বলেন, “আগে আমাদের ঘর ছিল সাগরের অনেক ভেতরে। এখন সে জায়গা পুরাটাই সাগরের নিচে। প্রতিবছরই কিছু না কিছু ভেঙে যায়। সরকার শুধু দেখে, কিন্তু করে না কিছু।”
রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ির স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধি বলেন, কয়েকশ পরিবার বারবার স্থানান্তরিত হলেও এখন পর্যন্ত স্থায়ী পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নেই।
গর্জনিয়া ইউনিয়নের শাহানা আক্তার (৩২) বলেন, “তিনবার বাড়ি বদল করেছি। স্কুলে ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন ২ কিলোমিটার হেঁটে আসে। বর্ষা এলে আর আসতে পারে না।”
এলাকার শিক্ষকরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেবল ঘর-বাড়ি নয়, শিক্ষার ভবিষ্যৎকেও ভাসিয়ে নিচ্ছে। উপকূল রক্ষা, স্থানীয় পুনর্বাসন, এবং সচেতনতা বাড়ানো- এই তিন স্তরে প্রশাসনকে কাজ করার তাগিদ দিচ্ছেন স্থানীয় নেতারা ও পরিবেশবিদরা।
তারা বলছেন, সাময়িক ত্রাণ নয়, স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ গ্রামে দুর্যোগ প্রস্তুতির জন্য কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক গড়ে তুলতে হবে।
কক্সবাজারের সমুদ্র এখন শুধু উত্তাল নয়- সে মানুষের ভিটেমাটি, ইতিহাস আর ভবিষ্যৎ গ্রাস করছে। উপকূলের এই প্রতিনিয়ত ভাঙন কেবল একটি প্রাকৃতিক সমস্যা নয়, এটি একটি মানবিক বিপর্যয়, যা দীর্ঘদিনের অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার ফসল। এখনও সময় আছে- প্রশাসন, নীতিনির্ধারক, ও জনসাধারণের সমন্বিত উদ্যোগেই রক্ষা করা সম্ভব বাংলাদেশের এই অমূল্য উপকূল। এমন দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলা প্রশাসক মো. সালাহউদ্দিন বলেন, “যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোকে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা এবং আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ভাঙন রোধে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। ইতিমধ্যে কিছু এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রশাসন স্থানীয় সরকার, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছে।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর