
দুই সপ্তাহ আগেও যেখানে ছিল প্রাণচাঞ্চল্য, শিক্ষার্থীদের কোলাহল— সেই চিরচেনা ক্যাম্পাস আজ নিস্তব্ধ। ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার ১২ দিন পর আজ রবিবার খুলেছে রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। তবে ক্লাস কিংবা পরীক্ষা হয়নি। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আয়োজন করা হয় এক আবেগঘন স্মরণসভা, যেখানে কান্নায় ভেঙে পড়েন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
গত ২১ জুলাই কলেজ ভবনের ওপর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ বহু মানুষ নিহত ও আহত হন। ঘটনার পর থেকে বন্ধ ছিল মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সকল কার্যক্রম।
স্মরণসভায় ছিল কালো ব্যানার, নিহতদের ছবি, ফুল ও মোমবাতি। নিঃশব্দে বয়ে যাওয়া সেই দুঃসহ স্মৃতি যেন ভারাক্রান্ত করে রেখেছিল পুরো ক্যাম্পাস।
কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন (অব.) জাহাঙ্গীর খান বলেন, “আমরা এখনও মানসিকভাবে এই দুর্ঘটনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তবে সবার সহানুভূতি ও সহযোগিতায় আবারও এগিয়ে চলার চেষ্টা করছি।”
তিনি জানান, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনুরোধে ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের জন্য বিশেষ কাউন্সেলিং সেশন চালু করা হয়েছে।
কলেজের আরেক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম বলেন, “আগামীকাল সোমবারও ক্লাস হবে না। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলবেন মানসিক প্রস্তুতির জন্য। নিয়মিত ক্লাস শুরু হবে বুধবার থেকে। এছাড়া, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে আগামী তিন মাস ধরে কাউন্সেলিং কার্যক্রম চলবে।”
তিনি আরও বলেন, “এই মুহূর্তে আমাদের কেউ নিখোঁজ নেই। যাদের তাৎক্ষণিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, তাদের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে। নিহতদের তালিকা কলেজের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে কোনো বিভ্রান্তি না থাকে।”
জিয়াউল আলম আরও বলেন, “আমাদের মাইলস্টোন পরিবার আহত হলেও আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চাই। যারা পাশে ছিলেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এই কঠিন সময়ে গুজব নয়, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা নিয়েই আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই।”
তিনি জানান, আগামীকাল কলেজের পূর্বনির্ধারিত একটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বেশিরভাগ অভিভাবকই চান, শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে পড়াশোনায় ফিরে আসুক।
প্রায় দুই সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর আজ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের পদচারণা শুরু হয়। তবে তাদের চোখেমুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ, বেঁচে থাকার ব্যথা ও হারানোর শোক। শিক্ষার্থীরা যেন নিঃশব্দ এক শোকযাত্রায় ফিরে এসেছেন পরিচিত শ্রেণিকক্ষে।
সকাল ১০টা থেকে শিক্ষার্থীরা কলেজের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করেন। কিন্তু সেই আগের কোলাহল ছিল না, ছিল শুধু নীরবতা। সকাল সাড়ে ১০টায় স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় মিলাদ মাহফিল ও শোকসভা। শ্রেণিকক্ষে বসে থাকা শিক্ষার্থীরা ছিলেন স্তব্ধ, বিনিময় করেছেন ধীরে কুশলাদি।
দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিরা বলেন, “প্রতিদিন যে ভবনের পাশ দিয়ে ক্লাসে যেতাম, আজ সেখানে শুধু পোড়া গন্ধ আর শূন্যতা। আজ ক্লাস হয়নি, শুধু বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।”
একই শ্রেণির শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “আমার পাশের বাসার ছোট ভাই এখানে ক্লাস করতো। আন্টি ওকে আমার সঙ্গে পাঠাতেন। এখন সে বার্ন ইউনিটে ভর্তি, এখনও সুস্থ হয়নি। এখানে এসে ওর কথাই মনে পড়ছে বারবার।”
দ্বাদশ শ্রেণির নওরোজ আফরিন বলেন, “কলেজে আসতে ভয় লাগছিল। আম্মু সঙ্গে এসেছে। ছোট ভাই-বোনদের মুখ ভেসে উঠছে চোখে। কান্না পাচ্ছে। কল্পনাও করিনি এভাবে ওদের হারাতে হবে। কী থেকে কী হয়ে গেল!”
কলেজের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ বুলবুল বলেন, “শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে, সেই লক্ষ্যে সীমিত পরিসরে ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া হয়েছে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা শিক্ষক ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন, যা তাদের মানসিক স্বস্তিতে সহায়ক হবে।”
তিনি আরও জানান, কলেজে বিমানবাহিনীর সহায়তায় একটি মেডিকেল ক্যাম্প চালু রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পরামর্শ পাচ্ছেন। শিক্ষকরা নিয়মিত কাউন্সেলিং করছেন এবং শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত আলাপের সুযোগও দেওয়া হচ্ছে।
শাহ বুলবুল বলেন, “এই দুঃসময়ে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সহানুভূতি ও মানবিকতা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে উঠেছে।”
সর্বশেষ খবর
জাতীয় এর সর্বশেষ খবর