
ভোরের আলো ফোটেনি তখনো। প্রতিদিনের মতোই নাফ নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন পাঁচ জেলে। কিন্তু সেই সকাল আর পাঁচটা সকালের মতো হয়নি। ওই দিনই বদলে গেল পাঁচটি পরিবার, অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল পুরো গ্রাম। অস্ত্রের মুখে নৌকাসহ পাঁচ জেলেকে ধরে নিয়ে গেল মিয়ানমারের আরাকান আর্মি। তিন দিন পেরিয়ে গেছে, অথচ ফিরল না কেউ। এখন শুধু নদীর ঢেউয়ের শব্দে মিশে আছে মায়ের আর্তনাদ, স্ত্রীর কান্না আর সন্তানের হাহাকার। প্রতিটি মুহূর্তে তারা প্রার্থনা করছে, প্রিয়জন যেন জীবিত ফিরে আসে।
কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ উপকূল থেকে গত মঙ্গলবার সকালে মাছ ধরতে নাফ নদীতে গিয়েছিলেন তারা। হঠাৎ একটি স্পিডবোটে এসে অস্ত্রের মুখে নৌকাসহ ওই ৫ জনকে ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তারা নিখোঁজ। দিন গড়াচ্ছে, কিন্তু প্রিয়জনদের কোনো খোঁজ পাচ্ছে না পরিবারগুলো। নিখোঁজদের বাড়িতে চলছে কান্নার রোল, শোকের মাতমে নিস্তব্ধ হয়ে আছে গোটা গ্রাম।
নিখোঁজ জেলেদের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন, শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়ার মোহাম্মদ ইলিয়াছ, তার দুই ছেলে আক্কল আলী ও নুর হোসেন, কালু মিয়ার ছেলে সাবের হোসেন এবং নুর হোসেনের ছেলে সাইফুল ইসলাম।
ইলিয়াছের স্ত্রী কেঁদে কেঁদে বললেন, আমার স্বামী আর দুই ছেলে— তিনজন একসাথে চলে গেল। এখনো ফেরত আসেনি। আমরা কীভাবে বাঁচব? কাকে নিয়ে বাঁচব?
সাবের হোসেনের মা ভাঙা গলায় আক্ষেপ করে বলেন, আমার ছেলেকে ফেরত দিন, আমি আর কিছু চাই না। তিন দিন হলো খাবার মুখে তুলিনি।
শিশু সাইফুল ইসলামের মা অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলে তো এখনো বালক বয়সের, সে কার কী ক্ষতি করেছে? কেন ধরে নিয়ে গেল ওকে?
শুধু পরিবার নয়, আশপাশের মানুষও শোকে ভেঙে পড়েছেন। কাঁদতে কাঁদতে এক প্রতিবেশী বলেন, এভাবে জেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়া তো নতুন কিছু নয়। কিন্তু সরকার কবে এর স্থায়ী সমাধান করবে?
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন জানান, জেলে নিখোঁজের ঘটনাটি সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে অবহিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, আশা করা যায় দ্রুত সময়ের মধ্যে জেলেদের ফেরত পাওয়া যাবে।
অন্যদিকে, কক্সবাজারের রামু বিজিবি সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক সময় দেখা যায় জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে মিয়ানমারের জলসীমায় চলে যায়। তখন মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী তাদের ধরে নিয়ে যায়। আসলে মিয়ানমারের কারো এখতিয়ার নেই বাংলাদেশের জলসীমা থেকে কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়ার। তাই জেলেদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে।
দেড় বছর ধরে নাফ নদীর ওপারের মিয়ানমার অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মি। এর ফলে সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকা ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। একদিকে দারিদ্র্যের তাড়নায় নদীতে মাছ ধরার প্রয়োজন, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত অপহরণের আতঙ্ক তাদের ঘিরে ধরছে।
শাহপরীর দ্বীপের স্থানীয় ইউপি সদস্য বলেন, আমাদের জেলেরা নাফ নদী ছাড়া বাঁচতে পারে না। কিন্তু এখন সেই নদীই হয়ে উঠেছে আতঙ্কের নাম। প্রশাসনের কাছে আমাদের একটাই দাবি— নাফ নদীতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন, যাতে আমরা শান্তিতে জীবন-জীবিকা চালাতে পারি।
পরিবারগুলোর চোখে এখন একটাই আকুতি। প্রিয়জনদের যেন দ্রুত জীবিত অবস্থায় ফেরত আনা হয়। নাফ নদীর ওপার থেকে কখন ভেসে আসবে সুসংবাদ— এই অপেক্ষায় দিশেহারা দিন কাটাচ্ছেন তারা।
রার/সা.এ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর