
নিরীক্ষকরা সৎ হলে তাদের মাধ্যমে কেউ দুর্নীতি করতে পারবে না এবং এর ফলে আর্থিক কেলেঙ্কারি রোধ করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে এই ব্যবস্থাটি কয়েকজন লোকের হাতে বন্দি, যে কারণে দেশে সৎ নিরীক্ষক থাকা সত্ত্বেও তারা কোনো কাজ পায় না। বড় বড় কোম্পানিগুলো নিজেদের পছন্দমতো নিরীক্ষক নিয়োগ দিয়ে তাদের দুর্নীতি ধামাচাপা দেয়।
কয়েক দশক ধরে শেয়ারবাজার, ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত দুর্নীতির সহযোগী নিরীক্ষকদের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে গত রবিবার (৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫) জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা আকরাম খাঁ হলে দেশের স্বনামধন্য নিরীক্ষক আমিনুল ইসলাম এফসিএ এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি নিরীক্ষকদের দ্বারা দুর্নীতি রোধে একগুচ্ছ প্রস্তাব সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিভিন্ন প্রস্তাব ও সংস্কার দাবি পেশ করেন।
**বাংলাদেশে নিরীক্ষা সেবার দুর্বলতা, মানহীনতা ও অকার্যকারিতার কারণসমূহ:**
1. একক মালিকানার ফার্মের অনুমোদন দেওয়া।
2. সকল সদস্যের সমান আইনত অধিকার থাকলেও তাদের পেশাগত অধিকার কাউন্সিল নিশ্চিত করার প্রয়োজন মনে করেনি।
3. ২ বছরের বাধা তৈরি এবং ৫/১০ বছরের অভিজ্ঞতার শর্ত আরোপ।
4. ফরেইন অ্যাফিলিয়েশনের নামে ২ জনের অবৈধ সুবিধা, অথবা ৪ জনের অসম্ভব শর্ত।
5. পরিচালক/এমডি/চেয়ারম্যানের সাথে আঁতাত করে/ঘুষের বিনিময়ে কাজ ভাগিয়ে নেওয়া, নিরীক্ষা না করে ক্লিন রিপোর্ট দেওয়া।
6. কোম্পানি আইন ১৯৯৪ এর ধারা ২১০ এবং ২১৩ এবং ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ৩৯ ধারা পুরোপুরি লঙ্ঘন করা, বছরজুড়ে নিরীক্ষক অনুপস্থিত থাকা।
7. সকল কাজ হাতিয়ে নিয়ে তরুণ সিএদের ম্যানেজার/ডিরেক্টর করে শ্রমের শোষণ, অনিশ্চিত ক্যারিয়ারের দিকে ঠেলে দেওয়া।
8. তালিকাভুক্ত কোম্পানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষার ব্যক্তি সিলিং/সীমা না থাকা, একজন ৮টি ব্যাংক বা ১৬টির অধিক তালিকাভুক্ত কোম্পানি নিরীক্ষা করা।
9. বাংলাদেশ ব্যাংকের উপর প্রভাব বিস্তার করে নগদ প্রণোদনার কাজ বোর্ডের অনুমোদনের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া, গুটি কয়েক ব্যক্তি এই দুর্নীতির সাথে জড়িত।
10. ত্রৈমাসিক আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষক দ্বারা রিভিউয়ের শর্ত প্রতিপালন না করা।
11. তরুণদের নিরীক্ষা পেশায় আসার পথে বাধার মহাপ্রাচীর তুলে রাখা, ২ বছরের বাধা, অভিজ্ঞতার শর্ত, ঘোড়ার আগে সর্বত্র গাড়ি জুড়ে দেওয়া।
12. মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সিওপি বজায় রাখা, কোনো অবসর বয়সের সীমা নির্ধারণ না করা।
13. নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী আর্টিকল্ড ছাত্রের সীমা ১৫ থেকে বাড়িয়ে ৪০ করা।
14. অস্বচ্ছ পরীক্ষা সিস্টেম, সিলেবাসের অসামঞ্জস্যতা, কাজের সুযোগ সীমিত করে রাখা।
15. নিরীক্ষা ফার্মকে পারিবারিক বা ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনা করা, ইনস্টিটিউশন আকারে দাঁড় না করানো।
16. নিজেদের স্বার্থে সিন্ডিকেট গড়ে তোলা, নির্বাচনের নাটকের নামে কাউন্সিল নির্বাচনে নিজেদের সিন্ডিকেটকে জয়ী করানো।
17. এফআরসিকে অসহযোগিতার মাধ্যমে অকার্যকর করে রাখা।
18. একক মালিকানার ফার্মগুলোকে বলির পাঠা বানানো এবং তা মিডিয়ায় ঘটা করে প্রচার করা।
19. ফ্যাসিবাদী দলের শাখা কমিটি খোলা এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যাবতীয় দুর্নীতি নির্বিচারে করে যাওয়া।
20. বিভিন্ন শিল্প গ্রুপের নিরীক্ষা একই নিরীক্ষক যুগের পর যুগ করে যাচ্ছে, ভুয়া অডিট রিপোর্ট দিয়ে সরকারের ট্যাক্স এবং ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া, ব্যাংকের ঋণের টাকা লোপাট করতে সহযোগিতা করা এবং গ্রুপের নেট সম্পদ প্রকাশ না করা। আইসিএবি সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি বলে তা সংস্কার আনতে ব্যর্থ হওয়া।
21. সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা কম ফিতে নেওয়া, ড্রাফট রিপোর্টে অডিট অবজারভেশন দিয়ে উচ্চ ঘুষের বিনিময়ে তা আবার তুলে নেওয়া।
22. আইপিওতে ভুয়া অডিট রিপোর্ট দেওয়ার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ হাতিয়ে নেওয়া যোগসাজশে।
23. কাউন্সিল মেম্বারগণ বিভিন্ন কোম্পানিতে সরকার মনোনীত পরিচালক হিসেবে নিয়োগ লাভ করা।
**সংস্কার দাবি - কাউন্সিল আইসিএবি এর প্রতি:**
1. সকল একক মালিকানার ফার্মের অনুমোদন বাতিল করতে হবে, নতুন কাউকে দেওয়া যাবে না, ফার্মগুলোর মার্জারের ব্যবস্থা বিনা ব্যয়ে করতে হবে।
2. ফরেইন অ্যাফিলিয়েশনের নামে অবৈধ সুবিধা সব জায়গা থেকে অনতিবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
3. পাশ করার পরে পেশায় আসার ০২ বছরের অবৈধ বাধা উঠিয়ে নিতে হবে।
4. কাউকে পার্টনার বা মালিকানার অংশীদার না বানিয়ে ফার্মের ম্যানেজার/ডিরেক্টর বানিয়ে দাসত্ব আর শোষণ বন্ধ করতে হবে অনতিবিলম্বে, এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি এবং ফার্মসমূহকে সিওপি নবায়নের সময় এফিডেভিট আকারে জমা দিতে হবে।
5. এফআরসিকে একমাত্র রেগুলেটর হিসেবে কার্যকর করতে হবে এবং এফআরসি এর তালিকা দিয়ে বাকি সকল প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রতিস্থাপন করতে হবে।
6. নতুন ফার্ম প্র্যাকটিসের অনুমোদনের জন্য আবেদন করার ২১ দিনের ভিতরে সার্টিফিকেট অফ প্র্যাকটিস ইস্যু করতে হবে, সিওপি পাওয়ার ৪০ দিনের ভিতরে এফআরসি এর নিবন্ধন নতুন ফার্মকে দিতে হবে। অথবা উভয় নিবন্ধন ৩০ দিনের ভিতরে দিতে হবে।
7. শেয়ারবাজার এবং ব্যাংক লুটের সাথে যারা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল সে সকল ফার্মের বিরুদ্ধে তদন্ত এবং ফৌজদারি আইনে বিচার এবং কাউন্সিলের দ্বারা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, তদন্ত প্রতিবেদন জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে।
8. সিন্ডিকেট তৈরি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে দোষী ফার্মগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। এনরন কেলেঙ্কারির তুলনায় সিন্ডিকেট তৈরি করা শতগুণে বৃহৎ অপরাধ। এনরন কেলেঙ্কারিতে আর্থার এন্ডারসন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
9. যেহেতু ৭০ ভাগ সিএ প্র্যাকটিসের বাইরে, সেহেতু কাউন্সিল নির্বাচনে ৬০ ভাগ সিট নন-প্র্যাকটিসিং মেম্বারদের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে, কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট কমাতে হবে।
10. সিএ পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে হবে।
**রাষ্ট্র, সরকার এবং রেগুলেটরের কাছে সংস্কার এবং আইন প্রণয়নের দাবি:**
1. এফআরসি এর তালিকা ব্যতীত সকল তালিকা বাতিল করতে হবে - অর্থ মন্ত্রণালয়।
2. নিরীক্ষা করার সিলিং বেঁধে দিতে হবে, যেমন প্রতি ৪ জন পার্টনার ১টি ব্যাংক নিরীক্ষা করতে পারবেন, এবং ১ জন পার্টনার সর্বোচ্চ ৪টি (আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া তালিকাভুক্ত কোম্পানি) নিরীক্ষা করতে পারবেন।
3. আইসিএবির কাউন্সিলে ২ জন প্রশাসন ক্যাডার অফিসারের স্থায়ী পদ সৃষ্ট করতে হবে, যারা গ্রেড ৭ এর নিচের কর্মকর্তা নন।
4. পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের অধীনে ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিট তৈরি করতে হবে যারা শেয়ারবাজার এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে যে অপরাধ ঘটে, যেমন হিসাবে কারচুপি/ম্যানিপুলেশন, শেয়ার ট্রেডিং এ ম্যানিপুলেশন এবং ইনসাইডার ট্রেডিং ঘটে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে অন্যত্র পাচার ঘটে তা তদন্ত এবং গ্রেপ্তার করতে পারবে।
5. বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে একজন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা, যাতে পুঁজিবাজারে হিসাবে ম্যানিপুলেশন করলে বা ট্রেডিং বা শেয়ার ইস্যুতে ম্যানিপুলেট করলে, তার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেলে সাথে সাথে গ্রেপ্তার করার নির্দেশনা দিতে পারেন।
6. হিসাব ম্যানিপুলেশন, শেয়ার ট্রেডিং ম্যানিপুলেশন, বা ব্যাংক ঋণ নিয়ে পাচার করলে তার বিচার করার জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে এবং এই অপরাধীদের গ্রেপ্তার এবং বিচার করতে হবে জামিন অযোগ্য ধারার মাধ্যমে।
7. সকল প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি এবং মেডিকেল কলেজ, যা ট্রাস্ট/ সোসাইটি আইন, ১৮৮২ অধীনে নিবন্ধিত এবং স্থাপিত, তাদের আর্থিক প্রতিবেদন পাবলিকলি প্রকাশ করার বিধান এবং এফআরসিকে অনুলিপি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে।
8. কোনো কোম্পানি ১০ কোটি টাকা বা তার অধিক ব্যাংক ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে গেলে, সে সকল কোম্পানির পরিচালনার জন্য সিএ ফার্মকে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে নিয়োগ করতে হবে ০৭ দিনের ভিতরে, স্পেশাল নিরীক্ষা করতে হবে। ঋণ খেলাপের ১ বছরের ভিতরে ঋণ স্বাভাবিক না হলে প্রণয়নের হিসেবে সিএ ফার্মকে আদালত দ্বারা নিয়োগ দিতে হবে। যুক্তরাজ্যের অনুরূপ। এই সংক্রান্ত আইনও পাশ করতে হবে। প্যানেল অফ লিকুইডেটর আদালত কর্তৃক তালিকাভুক্ত হবে।
9. কোনো কোম্পানি ২০ কোটি টাকা বা তার অধিক ঋণ নিলে বাধ্যতামূলকভাবে একজন সিএকে হিসাব ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বাধ্যতামূলক বিধান রাখতে হবে। প্রতি অতিরিক্ত ৩০০ কোটি টাকা ঋণের জন্য ১ জন করে সিএ নিয়োগ করার আইনগত বাধ্যতামূলক বিধান করা ঋণের শর্ত হিসেবে (হিসাব ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষার জন্য)।
10. নিরীক্ষা পেশার দুর্নীতি তদন্তে কোনো সচিব বা উপদেষ্টার কোনো রকম হস্তক্ষেপ না করা।
11. হাইকোর্টের একজন বিচারকের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের তদন্ত এবং রিফর্ম কমিশন গঠন করা, তার সদস্য হিসেবে একজন নিরপেক্ষ সিএ, যিনি পেশায় নেই, একজন অর্থনৈতিক সাংবাদিক, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের কর্মকর্তা, এবং একজন একাডেমিশিয়ান নিয়ে কমিশন, তদন্ত, এবং তার প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে - সুপারিশ সহ।
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর