
খাগড়াছড়ি জেলার সর্ববৃহৎ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ ক্রস ম্যাচিং পরীক্ষার সুবিধা নেই। এর ফলে জরুরি সার্জারি, ডেলিভারি, সিজারিয়ান এবং থ্যালাসেমিয়া রোগীরা প্রতিদিন নানা ধরনের ঝুঁকি ও ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন। একসময় এই হাসপাতালে পরীক্ষাটি চালু থাকলেও স্ক্রিনিং ডিভাইস শেষ হয়ে যাওয়ায় গত ২৫ মে থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে।
ক্রস ম্যাচিং হলো একটি রক্ত পরীক্ষার প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে রক্তদাতা ও রক্তগ্রহীতার রক্তের সামঞ্জস্য পরীক্ষা করা হয়। অস্ত্রোপচার বা রক্তপাতজনিত জরুরি অবস্থায় এটি জীবন বাঁচানোর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অথচ, জেলার প্রধান চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে এই পরীক্ষা না থাকায় রোগীদের বাইরের বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
এর ফলে রোগীর ঝুঁকি ও সময়ক্ষেপণ দুটোই বাড়ছে। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা রোগীদের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে, প্রসববেদনায় কাতর গর্ভবতী নারী, দুর্ঘটনার শিকার গুরুতর আহত রোগী কিংবা সিজারের জন্য অপেক্ষমাণ মায়েরা ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে পড়ছেন।
হাসপাতালে পরীক্ষা না থাকায় একজন রোগীকে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয়। সেখানে গিয়ে পরীক্ষা করাতে গড়ে ১ থেকে ২ ঘণ্টা সময় লাগে, যা অনেক সময় রোগীর অবস্থা আরও জটিল করে তোলে।
সরেজমিনে খাগড়াছড়ির ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে অনেক রোগীকে ক্রস ম্যাচিং পরীক্ষা করাতে দেখা গেছে। মাটিরাঙ্গা উপজেলার তবলছড়ি থেকে আসা তাসলিমা আক্তার খাগড়াছড়ি মেডিকেল সেন্টারে এসেছেন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু বাচ্চাকে ক্রস ম্যাচিং পরীক্ষা করাতে। তিনি জানান, "আমার ছেলে থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত। বাচ্চার শরীরে রক্ত দিতে হবে। ডাক্তার বলেছে ক্রস ম্যাচিং পরীক্ষা করাতে। হাসপাতালে পরীক্ষা না থাকায় আমি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এসেছি। হাসপাতালে পরীক্ষাটা করাতে পারলে ভালো হতো। বাইরে খরচও বেশি আবার অনেক কষ্ট হয়।"
কিউর হাসপাতালে আসা রোগীর ভাই শফিকুল ইসলাম জানান, তার বোন ডেলিভারির জন্য খাগড়াছড়ি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। চিকিৎসক বলেছেন রক্তের প্রয়োজন হবে, তাই তিনি কিউর হাসপাতালে এসেছেন ক্রস ম্যাচিং পরীক্ষার জন্য। তার কাছে রক্তের ব্যাগসহ ১৫০০ টাকা নেওয়া হয়েছে।
এদিকে খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে ক্রস ম্যাচিং পরীক্ষা না থাকায় বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন ফি রাখার অভিযোগ রয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ১০০০, কেউ কেউ ১২০০ আবার কেউ ১৫০০ টাকা করে ফি রাখছে। রক্তের ব্যাগসহ এই ফি দাঁড়ায় ১৫০০-১৮০০ টাকায়।
এ বিষয়ে খাগড়াছড়ি ডায়াগনস্টিক ক্লিনিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আকবর হোসেন বলেন, "আমরা চেষ্টা করি রোগীদের সর্বোচ্চ সেবাটুকু দিতে। ক্রস ম্যাচিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা। এটি নিখুঁতভাবেই করতে হয়। যার কারণে ফি'র ভিন্নতা থাকতে পারে। আমাদের নির্ধারিত একটি ফি রয়েছে। এর কম নেওয়া যাবে কিন্তু অতিরিক্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। আমরা সবাইকে নিয়ে সমন্বয় করে ফি আরও কমিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করব।"
খাগড়াছড়ি ব্লাড ডোনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামরুল ইসলাম বলেন, "খাগড়াছড়ির প্রধান স্বাস্থ্যকেন্দ্র হলো জেলা সদর হাসপাতাল। এ হাসপাতালেই ক্রস ম্যাচিং পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি খুবই অমানবিক দেখায়। বিনামূল্যে রক্ত দেওয়ার পরও আমাদের ব্লাড ডোনারদের ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। খাগড়াছড়ি হাসপাতালে অতি দ্রুত ক্রস ম্যাচিং পরীক্ষা চালু করার দাবি জানাচ্ছি।"
একজন অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "জরুরি অবস্থা নিয়ে হাসপাতালে যাই, কিন্তু বলে ক্রস ম্যাচিং বাইরে করতে হবে। তখন দৌড়ে বাইরে যেতে হয়। এর মধ্যে রোগীর জীবন নিয়ে শঙ্কায় পড়ে যাই। এটা খুবই উদ্বেগজনক।"
এদিকে বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ক্রস ম্যাচিং পরীক্ষা করতে গিয়ে আর্থিক ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে রোগীদের। হাসপাতালে এই পরীক্ষা করা হতো মাত্র ৩৫০ টাকায়। আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে করা হচ্ছে ১২০০-১৫০০ টাকা করে। ফলে ক্রস ম্যাচিং পরীক্ষা না থাকায় সাধারণ মানুষকে অতিরিক্ত ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা গুনতে হয়। অনেক সময় দালাল চক্র সুযোগ নিয়ে রোগীর পরিবারকে বিভ্রান্ত করে, যা রোগীর চিকিৎসা ব্যয় ও মানসিক চাপ উভয়ই বাড়িয়ে দেয়।
খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের ল্যাব সহকারী ভোপেন ত্রিপুরা বলেন, "ক্রস ম্যাচিং পরীক্ষাটি মূলত ৫টি পরীক্ষার একটি সমন্বিত পরীক্ষা। আগে আমাদের এখানে ক্রস ম্যাচিং পরীক্ষা করা হতো। বর্তমানে পর্যাপ্ত কিট না থাকায় এই সেবা বন্ধ রয়েছে। তবে কেউ যদি ৫টি পরীক্ষা আলাদাভাবে করে নেয় তাহলে এখানেই ক্রস ম্যাচিং করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারি ফি অনুযায়ী রোগীর ফি বেড়ে যাবে।"
খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের আরএমও রিপেল বাপ্পি চাকমা বলেন, "সারা দেশের জন্য ঢাকা থেকে একটি প্রকল্প চালু ছিল যেটা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। যার কারণে গত মে মাস থেকে খাগড়াছড়ি হাসপাতালে ক্রস ম্যাচিং পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা এ বিষয়ে বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদেও চিঠি দেওয়া হয়েছে কিন্তু কোনো ফলাফল পাচ্ছি না। বরাদ্দ পেলে এই পরীক্ষা চালু করা সম্ভব হবে।"
সাধারণ মানুষ ও স্থানীয় সচেতন মহল মনে করছেন, জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালেই যদি জীবনরক্ষাকারী এমন একটি মৌলিক পরীক্ষা না থাকে, তবে তা নিঃসন্দেহে খুবই উদ্বেগের বিষয়।
তারা সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিভিল সার্জন অফিসের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন, যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্রস ম্যাচিং পরীক্ষার সুবিধা চালু করা হয়, যা খাগড়াছড়ির হাজারো রোগীর জীবন রক্ষা করতে পারে।
এ বিষয়ে খাগড়াছড়ি জেলা সিভিল সার্জন মো. ছাবের হোসেন বলেন, "ক্রস ম্যাচিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা। গত ২৫ মে থেকে এই পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। এটি পুনরায় চালু করতে আমরা চেষ্টা করছি। ক্রস ম্যাচিং পরীক্ষা ছাড়াও আরও বেশকিছু পরীক্ষার কিট আমাদের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা এসব বিষয়ে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। এখনো কোনো রেসপন্স পাইনি। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি। হাসপাতালে আবারও ক্রস ম্যাচিং পরীক্ষা চালু করতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।"
সর্বশেষ খবর