
হবিগঞ্জ-১ আসনে সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন দল তাদের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে প্রচারণায় নেমেছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে দেয়াল লিখন, গেট ও তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে, এ আসনে বৃহত্তম দল বিএনপির ১০ জন প্রার্থী মনোনয়নের জন্য লবিং ও গ্রুপিং করছেন, যা নিয়ে তৈরি হয়েছে জল্পনা। কে পাবেন বিএনপির টিকিট, তা নিয়ে চলছে জোর আলোচনা।
সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা নবীগঞ্জকে ঘিরে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন জমে উঠেছে। দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় ধরে এ আসনে আওয়ামী লীগের আধিপত্য থাকলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামি ঘরানার দলগুলো মাঠে সক্রিয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের সুর থাকায় নির্বাচনী সমীকরণে নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে।
হবিগঞ্জ-১ আসনটি নবীগঞ্জ ও বাহুবল দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে নবীগঞ্জে সবচেয়ে বেশি লন্ডন প্রবাসী বসবাস করেন, যাদের সংখ্যা লক্ষাধিক। ইতিপূর্বে দুজন লন্ডন প্রবাসী প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতিটি নির্বাচনেই বাহুবলের চেয়ে নবীগঞ্জে প্রার্থীদের সংখ্যা বেশি থাকে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি নির্বাচনে নবীগঞ্জের প্রার্থীরাই বিজয়ী হয়ে আসছেন, একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ২০১৪ সালের একক নির্বাচন, যেখানে বাহুবলের অ্যাডভোকেট আমাতুল কিবরিয়া চৌধুরী কেয়া নির্বাচিত হয়েছিলেন।
পূর্ববর্তী বেশিরভাগ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হলেও এবার হবিগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে উঠেছে। ১০ জন প্রার্থী বিএনপি থেকে মনোনয়ন লাভের জন্য লড়াই করছেন। তাঁদের মধ্যে ৪ জন লন্ডন প্রবাসী এবং ১ জন আমেরিকা প্রবাসী বিএনপি নেতা রয়েছেন। এত অধিক সংখ্যক প্রার্থী অন্য কোনো দলে দেখা যাচ্ছে না, যা বিএনপির মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচারণার কারণ হয়েছে। কে পাবেন বিএনপির টিকিট, তা এখন মুখ্য আলোচনার বিষয়।
আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনে বর্তমানে বিএনপি নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। বিএনপির ১০ জন প্রার্থীর মধ্যে মনোনয়ন যুদ্ধ তৈরি হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৯ জনের বাড়ি নবীগঞ্জ উপজেলায় এবং ১ জনের বাড়ি বাহুবলে। মনোনয়ন নিয়ে দলের মধ্যে বিভক্তির আশঙ্কা থাকলেও, শেষ পর্যন্ত বিএনপি শক্তিশালী হয়ে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
হবিগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। নতুন করে আলোচনায় এসেছেন ড. রেজা কিবরিয়া ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. খালেদ মহসিন। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের একক প্রার্থী থাকায় তারা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা এখন পর্যন্ত ১০ জন। মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সুজাত মিয়া, জোবাইদা রহমানের খালু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. খালেদ মহসিন, নবীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র ছাবির আহমদ চৌধুরী, যুক্তরাজ্য যুবদলের সাবেক সহসভাপতি তালহা চৌধুরী, শিকাগো বিএনপির সভাপতি শাহ মোজাম্মেল নান্টু, নবীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক ও সাবেক ছাত্রনেতা মুশাহিদ আলম মুরাদ, বিএনপি নেতা শেখ মহি উদ্দিন, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা মুখলিছুর রহমান, যুক্তরাজ্য যুবদলের সাবেক সভাপতি দেওয়ান মুকাদ্দিম চৌধুরী নিয়াজ, নবীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মতিউর রহমান পেয়ারা প্রমুখ।
এছাড়াও, ২০১৮ সালে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করা সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার পুত্র ড. রেজা কিবরিয়া আবারও বিএনপির টিকিটে নির্বাচন করতে পারেন বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। যদিও তিনি দীর্ঘদিন ধরে মাঠে নেই, তবে বিএনপির একটি শক্তিশালী গ্রুপ তাকে প্রার্থী করানোর জন্য তোড়জোড় করছে।
এদিকে, সাবেক এমপি শেখ সুজাত মিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন বিএনপি তরুণ প্রার্থী ও সাবেক ছাত্রনেতা মুশাহিদ আলম মুরাদ। তাঁর ব্যানার-ফেস্টুন সর্বত্র ছেয়ে গেছে। নবীগঞ্জ ও বাহুবলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাঁর নামে গেট ও তোরণ নির্মিত হয়েছে। তরুণদের একটি বড় শক্তি তাঁর পক্ষে প্রচারণা করছে। মুশাহিদ আলম মুরাদ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে।
অন্য প্রচারণাকারী প্রার্থীদের মধ্যে সদ্য দলীয় পদ স্থগিত হওয়া সাবেক মেয়র ছাবির আহমদ চৌধুরী, শিকাগো বিএনপির সভাপতি শাহ মোজাম্মেল নান্টু এবং যুক্তরাজ্য যুবদলের সাবেক সহসভাপতি তালহা চৌধুরী মাঠপর্যায়ে সক্রিয় রয়েছেন। বাকিদের নাম শোনা গেলেও তাদের ভক্তরা শুধু ফেসবুকে প্রচারণা করছেন। আশা করা হচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যে তাঁরাও মাঠে নামবেন।
নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, হবিগঞ্জ-১ আসনে ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৩১ হাজার ৪২২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ১৭ হাজার ৮৭৬ জন, নারী ২ লাখ ১৩ হাজার ৫৪৪ জন এবং হিজড়া ভোটার ২ জন।
মনোনয়ন পাওয়া প্রসঙ্গে নবীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক ও সাবেক ছাত্রনেতা মুশাহিদ আলম মুরাদ বলেন, "আমি বিগত ১৫ বছর ধরে দলের জন্য কাজ করছি। ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে আমি সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছি। আমার উপর যত মামলা হয়েছে, আর কারো উপর হয়নি। কেউ কেউ আন্দোলনের সময় নিরাপদ থাকার জন্য বিদেশে পালিয়ে ছিলেন। দলের হাইকমান্ড এসব বিষয়ে অবগত আছেন। আমি বিশ্বাসী, তারেক রহমান তারুণ্যের জয়গান তুলেছেন, তাই আমি মনোনয়ন পাব নিশ্চিত।"
যুক্তরাজ্য যুবদলের সাবেক সহসভাপতি তালহা চৌধুরী বলেন, "আমি দলের সব কর্মসূচিতে সহযোগিতা করেছি। তারেক রহমানের ৩১ দফা নিয়ে মাঠে কাজ করেছি। দীর্ঘদিন মাঠে কাজ করেছি, দল আমাকে মূল্যায়ন করবে এটাই আমার বিশ্বাস।"
শেখ সুজাত মিয়া বলেন, "আমি ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়েছি। দীর্ঘদিন ধরে দলের জন্য কাজ করছি। আশা করি, দল আমাকে মূল্যায়ন করবে।"
ছাবির আহমদ চৌধুরী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, "প্রতিকূল সময়ে রাজনীতি করেছি, হেভিওয়েট প্রার্থীদের হারিয়ে দুইবার মেয়র হয়েছি। মামলা-হামলা মোকাবিলা করে দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছি। মনোনয়ন পাওয়ার আশা করছি।" সম্প্রতি তার দলীয় পদ স্থগিতের ব্যাপারে তিনি বলেন, "আমি আশাবাদী, শীঘ্রই এই আদেশ প্রত্যাহার করবে দল।"
ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, "আমি হবিগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচন করব। তবে কোন দল থেকে নির্বাচন করব, এখন ঠিক করিনি। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেব।" এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আমি বিএনপি থেকে যেহেতু ধানের শীষ নিয়ে একবার নির্বাচন করেছি, আবারও করতে কোনো দ্বিধা নেই।"
ডা. খালেদ মহসিন বলেন, "আমাকে নির্বাচন করার জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেইনি।"
নবীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মতিউর রহমান পেয়ারা বলেন, "আমাদের বড় দল, প্রার্থী সংখ্যা বেশি হওয়া স্বাভাবিক। আমাদের দলের মনোনয়ন যিনি পাবেন, আমরা তার পক্ষে কাজ করব। আমি নিজেই দলীয় মনোনয়ন চাইব।"
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর