
খাগড়াছড়িতে ৫ দিনের অবরোধ শেষে মঙ্গলবার রাতে তা ৫ অক্টোবর পর্যন্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছে জুম্ম ছাত্র-জনতা। মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) রাত ৯টায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এ ঘোষণা দেয় মিডিয়া সেল।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির উপর বিবেচনা করে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার। তিনি বলেন, 'আপাতত ১৪৪ ধারা জারি থাকবে। আমরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখে প্রত্যাহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।'
খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের অভিযোগ করা সেই কিশোরীর ধর্ষণের আলামত পায়নি মেডিকেল টিম। যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৩ জন নিহত, ১৩ সেনা সদস্যসহ ২৮ জনেরও অধিক আহত, জ্বালাও-পোড়াও, অবরোধ, ১৪৪ ধারা, সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির পর জানা গেল সেই কিশোরীর মেডিকেল পরীক্ষায় ধর্ষণের কোনো আলামতই মেলেনি। চলমান উত্তেজনার মধ্যেই নতুন মোড় দিয়েছে এ রিপোর্ট।
খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের গাইনি ডাক্তার জয়া চাকমার নেতৃত্বে করা এ মেডিকেল পরীক্ষার রিপোর্টে সব স্বাভাবিক রয়েছে। ডা. জয়া চাকমা ছাড়াও মেডিকেলের ওই রিপোর্টে স্বাক্ষর করেছেন ডা. মীর মোশাররফ হোসেন ও ডা. নাহিদ আক্তার।
এদিকে ধর্ষণের অভিযোগে ২৪ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার শয়ন শীলের অবস্থানের সিসিটিভি ফুটেজ ঘেঁটে দেখা যায়, ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ৯.২৩ মিনিটে খাগড়াছড়ি বাজারের পুকুর পাড়ের রাধাশ্রী শিল্পালয়ে অবস্থান করছেন শয়ন শীল। রাত ৯.৪৪ থেকে ৯.৪৭ মিনিট পর্যন্ত খাগড়াছড়ি বাজারের সাতকানিয়া স্টোর সংলগ্ন আল হাদী স্টোরে কেনাকাটা করছেন তিনি।
এরপর রাত ৯.৫০ থেকে ৯.৫২ মিনিটে খাগড়াছড়ি বাজারের মিতালী হার্ডওয়্যারের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে জানা গেছে, রাত সোয়া ১০টা পর্যন্ত শয়ন শীল বাজার এলাকাতেই ছিলেন। এর আগে ৯টা থেকে তিনি বাজারেই ছিলেন।
অথচ মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন রাত ৯টায় ভিকটিম বাড়িতে না ফেরায় ভিকটিমের বাবা তার প্রাইভেট টিচারের নিকট মেয়ের খোঁজ করেন। তখন প্রাইভেট শিক্ষক তাকে জানান, ভিকটিম শিক্ষার্থী ৯টায় বাড়িতে চলে গেছে।
তখন ভিকটিমের বাবা তাৎক্ষণিক আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামবাসীর সহযোগিতায় এলাকায় খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে ২৩ সেপ্টেম্বর রাত অনুমান ১১টার সময় সিঙ্গিনালাস্থ শাসন রক্ষিত বৌদ্ধ বিহারের পূর্ব পার্শ্বে মাটি ভরাটকৃত জায়গায় উপর তার মেয়েকে অজ্ঞান অবস্থায় পান।
পরে মেয়ের জ্ঞান ফেরার পর মেয়ে তাদের জানান যে, ২৩ সেপ্টেম্বর রাত অনুমান ৯টায় প্রাইভেট শেষে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে সিঙ্গিনালা সবিতা চাকমার বন্ধ দোকানের পার্শ্বে পৌঁছালে পিছন থেকে ৩ জন অজ্ঞাতনামা লোক মেয়ের মুখ চেপে ধরে শাসন রক্ষিত বৌদ্ধ বিহারের পূর্ব পার্শ্বে মাটি ভরাটকৃত জায়গায় উপর তুলে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে অজ্ঞাতনামা লোকজন ভিকটিমের নাকে মুখে চেতনাশক মেডিসিন লাগিয়ে দিয়ে অজ্ঞান করতঃ পালাক্রমে ধ'র্ষ'ণ করে পালিয়ে যায়।
তবে ঘটনার দিন ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার শয়ন শীল (১৯) এর অবস্থানের সিসিটিভি ফুটেজ জন্ম দিয়েছে নতুন কৌতুহলের। একদিকে মেডিকেল রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত না মেলা, অন্যদিকে গ্রেপ্তার হওয়া যুবকের অবস্থান ঘটনাস্থলে না হওয়ায় নানান জল্পনা-কল্পনা দেখা দিয়েছে।
খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ছাবের বলেন, ধর্ষণের ঘটনার মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদনটি আমি হাতে পেয়েছি। এটি পুলিশ সুপার কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবী, ধর্ষণের নাটক সাজিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছে সন্ত্রাসী সংগঠন ইউপিডিএফ। সাধারণ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর লোকদের আবেগকে তারা পুঁজি করে পাহাড়ি-বাঙ্গালী দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করেছে।
খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ বলেন, "ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সহিংসতা ঘটাতে চায়। তাদের এ চেষ্টা বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ। সকল তথ্য-প্রমাণ সেনাবাহিনীর কাছে রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জাতি-গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তৈরি রয়েছে। সেনাবাহিনীর উপর হামলা করে সৈনিকদের আহত করা হয়েছে। তারা বহিরাগত সন্ত্রাসীদের জড়ো করেছে, গুলি চালিয়েছে। আমাদের সাহসী সদস্যরা সম্মুখে থেকে ধৈর্যের সাথে তা মোকাবিলা করেছে।"
তিনি আরও বলেন, "অপপ্রচার ও উস্কানীমূলক কর্মকান্ড সত্ত্বেও সেনাবাহিনী বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ইউপিডিএফ সহিংসতায় নারী, কোমলমতি শিক্ষার্থী ও শিশুদের সামনে ঠেলে দেয়। এটা মোটেও ভালো বার্তা বহন করে না।"
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল বলেন, ‘এ সহিংসতায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা মামলা করতে চাইলে আমরা মামলা নেব। কেউ মামলা করতে না চাইলে প্রয়োজনে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে। কোন দুষ্কৃতকারীকে ছাড় দেওয়া হবে না। বর্তমানে ১৪৪ ধারা অব্যাহত রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথভাবে কাজ করছে। নতুন করে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না হয়, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।’
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত ১১টা থেকে অবরোধকারীরা অবরোধ প্রত্যাহার করেছে। আইনশৃঙ্খলার উন্নতির উপর নির্ভর করে ১৪৪ ধারাও প্রত্যাহার করা হবে। পরিবেশ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।"
উল্লেখ্য, গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের সিঙ্গিনালা এলাকায় প্রাইভেট পড়া শেষে ফেরার পথে অজ্ঞাত ৩ যুবক এক শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর বাবা বাদী হয়ে সদর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার পর সন্দেহভাজন হিসেবে শয়ন শীল (১৯) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত সব আসামিকে গ্রেপ্তার ও বিচারসহ আট দফা দাবিতে তিন পার্বত্য জেলায় চলছিল ‘জুম্ম ছাত্র-জনতার’ ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর