
৩০ সেপ্টেম্বর রাত দেড়টায় কক্সবাজারের উখিয়ার লেঙ্গুরবিলের একটি বসতবাড়িতে অভিযান চালায় উখিয়া থানার এস আই শের আলী। সেই সময় ওই ঘর থেকে ৬ কার্ড (৬০ হাজার) ইয়াবা সহ আবদুল আউয়ালকে আটক করা হয়। কিন্তু ভিন্ন ঘটনাস্থল দেখিয়ে মাত্র ৫ হাজার ইয়াবা সহ তাকে আদালতে পাঠানোয় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
আওয়ালের আত্মীয়-স্বজনদের দাবি, অভিযানস্থলও ‘পরিবর্তন’ করে দেখানো হয়েছে। তাকে বাড়ি থেকে আটক করা হলেও মামলায় লেখা আছে, টেকনাফ থেকে আসার সময় উখিয়া কৃষি ব্যাংকের নিচ থেকে আউয়ালকে ধরা হয়। অথচ তার বাড়ি সেই জায়গা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, একদল সাদা পোশাকধারী লোক হঠাৎ করেই তার বাড়িতে ঢুকে পড়ে। তারা কাউকে কিছু বুঝে উঠতে না দিয়েই তাকে জোরপূর্বক বাইরে নিয়ে যায়। উপস্থিত স্থানীয়রা বিষয়টি দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, ওই দলটি তার সঙ্গে বাড়ি থেকে প্রায় ছয় কার্ড ইয়াবা নিয়ে যায়। তবে ঘটনাস্থলে কোনো সরকারি বাহিনীর উপস্থিতি বা অফিসিয়াল তল্লাশি সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখা যায়নি, যা পুরো ঘটনাকে আরও রহস্যজনক করে তুলেছে।
জব্দ তালিকায় দেখা যায়, সেখানে মাত্র পাঁচ হাজার ইয়াবার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ স্থানীয় সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, উদ্ধার করা হয়েছিল প্রায় ৬০ হাজার ইয়াবা। শুধু তাই নয়, মাদক উদ্ধারের স্থানটিও ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন করেছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এত বড় মাদক উদ্ধারের পরও পুলিশ কোনো প্রেসবিজ্ঞপ্তি দেয়নি বা গণমাধ্যমকে অবহিত করেনি- যেখানে সাধারণত পাঁচশ পিস ইয়াবা উদ্ধার হলেও সাংবাদিকদের ডেকে প্রচার চালানো হয়। এই নীরবতা পুরো ঘটনাটিকে সন্দেহজনক করে তুলেছে।
এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় স্থানীয় কয়েকজন যুবকের। তারা বলেন, আমরা শুনেছি ৬০ হাজার ইয়াবাসহ আওয়ালকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু পরে মাত্র ৫ হাজার পিস ইয়াবা দেখিয়ে এসআই শের আলী তাকে আটক দেখায়। এতে এলাকায় হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয়দের মতে, আওয়াল ছিলেন ইয়াবা সিন্ডিকেটের বাহক। প্রকৃত মালিক মরিচ্যা সিএনজি সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান জিকু ও তার সহযোগী কামাল উদ্দিন। সম্পর্কের সূত্রে আউয়াল আসলে জিকুর চাচা। পুলিশি অভিযানে এই চালান ধরা পড়ার পর জিকু পুলিশের সঙ্গে আঁতাত করে পুরো বিষয়টি আড়াল করার চেষ্টা করেন।
স্থানীয়দের ধারণা, জিকু ও কামাল বহুদিন ধরে মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। সাম্প্রতিক টানাপোড়েনে জিকু নিজের চাচাকে বলি দিয়েছেন।
ইয়াবাসহ আউয়াল আটক হওয়ার পর থেকে আনিসুর রহমান জিকু ও কামাল উদ্দিনের হঠাৎ উত্থান নিয়ে এলাকায় চলছে নানা আলোচনা। কামালের কোনো স্থায়ী পেশা না থাকলেও এখন তিনি কোর্টবাজার এলাকায় একাধিক জমির মালিক। অন্যদিকে, জিকুর মালিকানায় রয়েছে দুটি ট্রাক ও কয়েকটি সিএনজি। স্থানীয়দের অভিযোগ- ইয়াবা ব্যবসার টাকায় তারা গড়ে তুলেছেন কোটি টাকার সাম্রাজ্য।
আব্দুল আউয়ালের স্ত্রী তৈয়বা বলেন, ‘ওইদিন রাত একটা বিশ মিনিটে ৫-৬ জন সাদা পোশাকধারী লোক আমার স্বামীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরে জানতে পারি, তাকে ৫ হাজার ইয়াবাসহ কোর্টে পাঠানো হয়েছে। তবে জব্দকৃত ইয়াবার প্রকৃত পরিমাণ তার পরিবারের সিনিয়র সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করে জানানো হবে।’
আওয়ালের আত্মীয় আব্দুল হক বলেন, ‘তাকে বাড়ি থেকে ধরা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশের এজাহারে তাকে টেকনাফ থেকে আসার সময় কৃষি ব্যাংকের নিচ থেকে আটক করেছে বলে মামলায় লেখা হয়েছে।’
উখিয়ার ব্যবসায়ী জসিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পুলিশ যদি উদ্ধার করা ইয়াবার চালান গায়েব করে, তাহলে বুঝতে হবে- মাদক উদ্ধারের ঘটনায় আসলে পুলিশেরই লাভ হয়েছে।’
স্থানীয় সমাজকর্মীদের অভিযোগ, এসআই শের আলী থানায় যোগদানের পর থেকেই টাকার বিনিময়ে মামলা বানিজ্য, ইয়াবা গায়েব, ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছেন।
উখিয়ার সংবাদকর্মী তারেক বলেন, ‘শের আলী এখন পুলিশের পোষাকে দানব হয়ে উঠেছেন। টাকা ছাড়া কোনো কাজই করেন না তিনি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই শের আলী বলেন, ৫ হাজার ইয়াবাসহ একজনকে আটক করা হয়েছে। তবে ৬০ হাজার ইয়াবার প্রশ্নে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্ন করেন, আপনি কি ইয়াবা ব্যবসায়ী? এরপর তিনি প্রতিবেদককে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে ফোন কেটে দেন।
মাদক গায়েবের পক্ষেই অনেকটা সাফাই গেয়ে উখিয়া থানার ওসি জিয়াউল হক বলেন, ‘তার কাছ থেকে ৫ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে।’ তবে এ বিষয়ে কোনো প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি কেন- এই প্রশ্নে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবিব পলাশ বলেন, ‘বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। প্রমাণ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কুশল/সাএ
সর্বশেষ খবর