
সকল রাজনৈতিক দলসমূহের নির্বাচনী ইশতিহারে আর.এম.জি.সহ সকল শ্রমিকদের দাবি অন্তর্ভুক্তি করার আহবান জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আর. এম. জি. ওয়ার্কিং গ্রুপ কোর কমিটি।
রবিবার (১২ অক্টোবর) সকাল সাড়ে দশটায় রাজধানী ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। যেখানে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সালাউদ্দিন স্বপন, সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি আইবিসি।
উপস্থিত সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে মূল বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি শ্রমজীবী মানুষ। বাংলাদেশে মোট শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় সাত কোটি সত্তর লক্ষ। এদের অধিকাংশই দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে।
আপনারা জানেন যে, তৈরি পোশাক শিল্প (আরএমজি) বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান ১০.৩৫% এবং বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশই আসে এইখাত থেকে। এই শিল্পে কর্মরত শ্রমিক রয়েছে প্রায় ৪০ লক্ষ, যার বেশিরভাগই নারী।
শ্রম আইন, সংবিধান ও আন্তর্জাতিক শ্রম মান/ ILO কনভেনশন, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ইত্যাদি শ্রমিকদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিলেও বাস্তবতার ক্ষেত্রে এসব অধিকার এখনও সুদূর পরাহত অন্যদিকে শ্রম সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে ও কাংখিত অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি।
এ হেন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই শিল্পে টেকসই শিল্প সম্পর্ক এবং শ্রমিকের অধিকার, কল্যাণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত, এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি বিবেচনায় নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ নিশ্চিত করা জরুরি। যার প্রতিফলন রাজনৈতিক দলসমূহের নির্বাচনী ইশতেহারে এ খাতের লক্ষ লক্ষ শ্রমিকেরা দেখতে চায়। এই বিবেচনায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা সরকার/ রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সংগঠন সমূহের নিকট নিন্মোক্ত দাবি/প্রস্তবনা সমূহ পেশ করতে যাচ্ছি, যাতে সরকার এইগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় ও রাজনৈতিক দল/ সংগঠন সমূহের নির্বাচনী ইশতেহারে দাবী সমূহ অন্তর্ভূক্ত করা হয় এবং নির্বাচিত হলে অনতিবিলম্বে প্রস্তবনা/ দাবী সমূহ বাস্তবায়ন করা হয়:-
নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভূক্তির জন্য আমাদের প্রস্তবনা /দাবী সমূহ:
১. ILO কনভেনশন অনুযায়ী শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন ও দরকষাকষির অধিকার ও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিতকরণঃ
• ইপিজেড/এসইজেডসহ সকল গার্মেন্টস শ্রমিকের জন্য একই শ্রম আইনের অধীনে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজীকরণ করা।
• ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকান্ড এবং যৌথ দরকষাকষির ক্ষেত্রে শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন সদস্যদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের না করা, বিদ্যমান সকল মামলা প্রত্যাহার, এবং আইনি সুরক্ষায় সরকারের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করা।
২. গার্মেন্টস শিল্পের টেকসই উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সম্প্রসারণ ও কাজের সুরক্ষাঃ
• দেশের রপ্তানি আয়ের মূলভিত্তি হিসেবে এই শিল্পকে টেকসই ভাবে গড়ে তোলা এবং এ লক্ষ্যে শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপশি এ খাতে কর্মসংস্থান সুযোগ বৃদ্ধি এবং একইসাথে বিদ্যমান কর্মরত শ্রমিকদের কাজের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
৩. জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা ও আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থাঃ
• আইনি সুরক্ষাসহ সার্বজনীন জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে গার্মেন্টস খাতের জন্য নিয়মিত মজুরি ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করা।
৪. নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চতকরণঃ
• নিরাপদ কর্মপরিবেশসহ কর্মস্থলে স্বাস্থ্যসেবা ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা, বিশেষ করে বিল্ডিং ও ফায়ার সেফটি ও ইলেকট্রিক সেফটি স্ট্যান্ডার্ড বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
• সেফটি কমিটি ও সেফটি অফিসারের কর্মক্ষমতা বাড়াতে আইন সংশোধন ও হালনাগাদ করা।
৫. সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরাঃ
• সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড বাধ্যতামূলক করা এবং Employment Injury Scheme (EIS) কে স্থায়ী রূপ দেয়া।
• গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য ‘কার্ড এর মাধ্যমে মাসিক ভিত্তিক রেশনিং’ ব্যবস্থা চালু করা, যাতে তারা ভর্তূকি মূল্যে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পেতে পারেন।
• ILO কনভেনশন ১২১ ও হাইকোর্ট নির্দেশনা অনুযায়ী দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে শ্রমিকের জন্য ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড নির্ধারণ করা।
• শ্রমিকের সন্তানদের জন্য নি:খরচায় মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা।
• গার্মেন্টস শ্রমিক ও তার পরিবারের সদস্যদের মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে গার্মেন্টস শিল্পাঞ্চলে জন্য নির্দিষ্ট হাসপাতাল স্থাপন করা এবং শ্রমিকের প্রয়োজন বিবেচনায় হাসপাতালসমূহে বিনামূল্যে সান্ধ্যকালীন সেবা চালু করা।
• শ্রমিকদের আকস্মিক কর্মহীনতাকালীন সময়ে সুরক্ষার জন্য বেকার ভাতা/ বিকল্প কাজের ব্যবস্থাসহ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৬. আবাসন ও কল্যাণ সুবিধা নিশ্চিতকরণঃ
• সকল গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য মানসম্মত আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
• সামাজিক কল্যাণমূলক সহায়তা/ সেফটিনেট কার্যক্রম গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য সম্প্রসারণ করা।
৭. মাতৃত্ব-পিতৃত্বলাকীন ও পরিবারবান্ধব নীতি প্রণয়নঃ
• চাকুরির সুরক্ষাসহ পাবলিক সেক্টরের ন্যায় ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি ও পূর্ণ বেতন, এবং মাতৃত্বকালীন সময়ে প্রসবকালীন ব্যয়সহ স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং পিতৃত্ব ছুটি চালু করা।
• শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রের মাধ্যমে নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ এবং এ লক্ষ্যে শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রের আধুনিকায়ন করা।
• প্রতিটি কারখানায় ডে-কেয়ার কেন্দ্র চালু করার পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক ডে-কেয়ার কেন্দ্র চালুকরণ।
৮. হয়রানি মুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণঃ
• কর্মক্ষেত্রসহ সকল ক্ষেত্রে ILO কনভেনশন ১৯০ এবং হাইকোর্ট নির্দেশনা (২০০৯) অনুযায়ী যৌন নিপীড়নসহ সকল প্রকার হয়রানি ও সহিংসতামুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা।
• কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধে পৃথক আইন প্রণয়ন করা।
• নারী শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা চালু করা।
৯. শ্রম অসন্তোষ নিরসন ও ন্যায় বিচার নিশ্চিতকরণঃ
• শ্রম আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি, ডিজিটালাইজেশন ও শ্রম আদালতকে কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মামলার দীর্ঘসূত্রীতা হ্রাস করা।
• বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR) প্রক্রিয়া চালু করা, যাতে শিল্প অসন্তোষ কমে এবং দ্রুত ন্যায়বিচার পাওয়া যায় এর মাধ্যমে সমাধান করা যায়।
১০. শ্রম পরিদর্শন, প্রশাসন ব্যবস্থার কার্যকারিতা, এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাঃ
• দেশের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা রক্ষার্থে শ্রম পরিদর্শন ও শ্রম প্রশাসন ব্যবস্থাকে অন্তর্ভূক্তিমূলক ও নিরপেক্ষ করা এবং একই সাথে স্বচ্ছতা ও জবাবাদিহিতা নিশ্চিত করা।
১১. অটোমেশন, জলবায়ু পরিবর্তন, জাস্ট ট্রানজিশনের প্রেক্ষিতে কর্মসংস্থান সুরক্ষা, প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং মানবাধিকার Due Diligence (HRDD) বাস্তবায়ন করাঃ
• প্রযুক্তির পরিবর্তনজনিত চাকরি হারানোর ঝুঁকি ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ ও দক্ষতা উন্নয়নের কৌশল নির্ধারণ, বিশেষত শ্রমিকের জন্য পুনঃদক্ষতায়নের ব্যবস্থা এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।
• শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা উন্নয়নের জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং তাদের দক্ষতার সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।
• গার্মেন্টস শ্রমিকদেরকে বঞ্চনা, অমানবিক পরিস্থিতি এবং সুরক্ষাহীনতা থেকে রক্ষা করতে মানবাধিকার Due Diligence (HRDD) এর প্রতি যথাযথ অঙ্গীকার ঘোষণা এবং Due Diligence (HRDD) সংক্রান্ত আইন ও নিতিমালা প্রণয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ।
১২. শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণঃ
• গার্মেন্টস খাতের ট্রেড ইউনিয়নসমূহ মনে করে যে, দেশের সকল শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার ও দাবীর প্রতি তাদের সংহতি ও অঙ্গীকার রয়েছে; সে প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রস্তাব হলো, শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইস্তেহারে অন্তর্ভূক্ত করা।
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
বাংলাদেশের উন্নয়ন, টেকসই অর্থনীতি, সামাজিক সমতা, মানবিক মর্যাদাবোধ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার নিশ্চিত করা অপরিহার্য। আমরা আপনাদের মাধ্যমে দেশের জনগন, শ্রমজীবী মানুষ এবং রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য সংগঠন সমূহকে অবহিত এবং প্রয়োজনীয় কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার জন্য আহবান জানাচ্ছি এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখিত প্রস্তবনা/ দাবী সমূহকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অন্তর্ভূক্ত করাসহ নির্বাচিত হওয়ার পর তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানাচ্ছি।
আমাদের কর্মসূচি সমূহ:
১. রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সংগঠন সমূহের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভূক্তির জন্য প্রস্তাবনা/ দাবী সমূহ পেশ/ হস্তান্তর।
• ১৫ অক্টোবর ২০২৫ থেকে ৩০ অক্টোবর ২০২৫ইং পর্যন্ত।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর