রাত পেরোলেই কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাংয়ের সাগরপাড়ে শুরু হয় অন্য এক জগৎ। যেখানে ঢেউয়ের শব্দের আড়ালে লেনদেন হয় কোটি কোটি টাকার ইয়াবা। সেই জগতের একমাত্র শাসক ‘মাদক সম্রাট’ জুবাইর। বহুদিন ধরে যে নামটি টেকনাফজুড়ে উচ্চারিত হয় ভয় আর প্রভাবের প্রতীকে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসে, আর এই ঘরের ভেতর থেকে ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা প্রান্তে।
দীর্ঘ গোয়েন্দা নজরদারির পর অবশেষে বিজিবি যখন জুবাইরের বিলাসবহুল প্রাসাদের দরজায় কড়া নাড়ে, তখনই উন্মোচিত হয় বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা মাদক সাম্রাজ্যের অন্ধকার অধ্যায়।
সেই সংঘবদ্ধ মাদক চক্রের গডফাদার হিসেবে পরিচিত জুবাইরের (৪০) বাড়িতে টানা আট ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান চালিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) রাতভর সাবরাং ইউনিয়নের মণ্ডলপাড়ায় পরিচালিত এই অভিযানে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা, নগদ অর্থ, দেশি অস্ত্র ও চোরাচালান কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
অভিযান চলাকালে দেয়াল টপকে পালানোর সময় আইয়ুব আলী (৩৭) নামে এক সহযোগীকে এবং বাড়ির ভেতরে আত্মগোপনে থাকা জুবাইরের স্ত্রী ফাইজা (১৯) কে আটক করা হয়। তবে অভিযানের সময় মূল হোতা জুবাইর পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) দুপুরে সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান।
বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সাবরাং মণ্ডলপাড়ার এই বাড়িটি দীর্ঘদিন ধরে ছিল গোয়েন্দা নজরদারিতে। স্থানীয়দের অভিযোগ ছিল- জুবাইর সীমান্তপথে ইয়াবা ও চোরাচালানের সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বিজিবির অর্ধশতাধিক সদস্য নিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমানের নেতৃত্বে বিশেষ অভিযান চালানো হয়।
বাড়িটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে বিজিবি সদস্যরা। প্রায় ৮ ঘণ্টাব্যাপী তল্লাশি অভিযান শেষে উদ্ধার করা হয় ১৯ হাজার ইয়াবা, নগদ ১০ লাখ ৩০ হাজার টাকা, দেশি অস্ত্র, ওয়াকিটকি, সিসি ক্যামেরা ও চোরাচালান সরঞ্জাম।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, জুবাইরের বাড়িটি ছিল আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও বিলাসবহুল স্থাপনায় গড়া। চারপাশে উঁচু দেয়াল, সিসি ক্যামেরার জাল, ওয়াকিটকি সংযোগ এবং একাধিক গোপন পথ ব্যবহার করা হতো পাহারার জন্য। বাড়ির ভেতর থেকে এমন কিছু ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ ও যোগাযোগ ডিভাইস উদ্ধার করা হয়েছে, যা সীমান্ত এলাকায় মাদক পাচারের সময় সিন্ডিকেট সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষায় ব্যবহার করা হতো বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জুবাইর একসময় সীমান্ত এলাকায় রোহিঙ্গা পাচার ও দালাল চক্রে যুক্ত ছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই চক্র থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন মাদক বাণিজ্যের নেটওয়ার্ক। সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ ও নাফ নদ সংলগ্ন এলাকায় তার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রতিদিনই লাখ লাখ টাকার ইয়াবা চালান আসত ও ছড়াতো দেশের বিভিন্ন জেলায়। বছরের পর বছর তার নাম প্রশাসনের নথিতে থাকলেও স্থানীয় প্রভাবশালীদের আশ্রয়ে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। একাধিক অভিযানের পরও জুবাইরের প্রভাববলয় ভাঙা যায়নি।
টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে আসছিলাম। নিশ্চিত তথ্য পাওয়ার পর অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা, নগদ অর্থ ও অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। আটক দুজনকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দিয়ে থানায় হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। মূল অভিযুক্ত জুবাইরকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
সাবরাং মণ্ডলপাড়ার এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, জুবাইরের বাড়ির চারপাশে অচেনা লোকজনের আনাগোনা ছিল নিয়মিত। কেউ কিছু বললেই ভয় দেখানো হতো। বিজিবির এ অভিযান এলাকায় অন্তত স্বস্তির নিঃশ্বাস এনেছে।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর