তারা দরজায় আসে ভিক্ষা চাইতে, মুখে করুণ সুর। 'মা, একটু পানি দেবেন?' কেউ হাত ধোয়, কেউ শৌচাগারে যেতে চায়। আর মুহূর্তেই ঘটে বিপর্যয়। চোখের সামনে অন্ধকার, তারপর শূন্য হয়ে যায় গহনা, টাকা আর সারা জীবনের সঞ্চয়। এইভাবেই একের পর এক গৃহবধূর জীবন থেকে সবকিছু কৌশলে কেড়ে নিচ্ছে এক নারীচক্র— যাদের হাতে ভিক্ষার থালা নয়, লুকিয়ে থাকে প্রতারণা আর অপরাধের ধারালো ছুরি।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সাবেকগুলদি এলাকার প্রবাসীর স্ত্রী শারমিন জান্নাতের বাড়িতে আসে সাত নারী। দরজায় দাঁড়িয়ে তারা কেউ ভিক্ষা চায়, কেউ আবার একটু পানি খাওয়ার অনুরোধ জানায়। শারমিনও ভাবেন, মানুষ তো ভিক্ষা চাইছে, একটু সাহায্য করলে ক্ষতি কী? কিন্তু সাহায্য করাই হয়ে দাঁড়ায় সর্বনাশের সূত্রপাত।
কথা বলার এক ফাঁকে এক নারী শারমিনের হাতে পানি চায়, অন্যজন বাথরুম ব্যবহারের অনুমতি নেয়। এরই মধ্যে আরেকজন গৃহবধূর সঙ্গে আলাপ জমিয়ে রাখে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথা ঘোরা আর জ্ঞান হারানোর আগে শারমিন শুধু দেখেছেন— একজন তার গলার হার খুলে নিচ্ছে। জ্ঞান ফেরে সন্ধ্যার পর। আলমারির দরজা খোলা, ঘর তছনছ, গয়না-টাকাসহ প্রায় ১০ ভরি স্বর্ণালংকার উধাও।
পুলিশ বলছে, এই নারীচক্রটি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জেলায় একই পদ্ধতিতে চুরি করে আসছে। চক্রটির নেতৃত্বে রয়েছেন চাঁদপুর জেলার রেনু বেগম (৬০)। তার অধীনে সাতজন নারী ও একজন পুরুষ সদস্য রয়েছে। তারা সবাই ভিক্ষুকের বেশে ঘুরে বেড়ান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চক্রটি আগে থেকে স্থানীয় এলাকায় খোঁজখবর নেয়— কোনো বাড়িতে নারী একা থাকে কি না, স্বামী প্রবাসে আছে কি না, পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বাইরে যায় কি না। এরপর নির্দিষ্ট টার্গেট ঠিক করে ফেলে।
প্রথম ধাপে এক বা দু'জন নারী গিয়ে দরজায় দাঁড়ায়। এরপর বাকিরা এসে যোগ দেয়। কেউ পানি চায়, কেউ ঘরে ঢুকে কথা বলে, আর এক সময় গৃহবধূকে অচেতন করার জন্য পানিতে বা চায়ে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। তারপর সোনা-গয়না, নগদ টাকা লুট করে তারা নির্ভয়ে চলে যায়।
এ ঘটনায় শারমিন জান্নাতের পরিবার পেকুয়া থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর গতকাল মধ্যরাত থেকে আজ শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত পেকুয়া, লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া এলাকায় একাধিক স্থানে অভিযান চালায় পুলিশ।
অভিযানে আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়— রেনু বেগম (৬০), মুক্তা বেগম (৩৮), রৌশন আরা বেগম (৬০), গোলাপী বেগম (৫৮), রুবি বেগম (৩৭), কাকলী বেগম (২৫), শেফালী বেগম (৪৫) ও সেলিম উদ্দিন (৪০)।
অচেতন হওয়ার পর থেকে আজও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন শারমিন জান্নাত। তিনি বলেন, 'ওরা এমনভাবে কথা বলছিল, যেন খুব অসহায়। আমি এক গ্লাস পানি দিলাম, তারপর মনে নেই কিছুই। চোখ খুলে দেখি গহনা নাই, ঘরের জিনিসপত্র উলটপালট।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি ভেবেছিলাম মানুষকে একটু সাহায্য করব, কিন্তু সেই করুণাই এখন অভিশাপ।'
তদন্তকারীদের মতে, চক্রটি মূলত চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে ঘুরে বসবাস করে। তারা লোহাগাড়ার আমিরাবাদ এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন। সেখান থেকেই তারা প্রতিদিন সকাল-বিকাল বিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষা করতে বের হতেন— আসলে টার্গেট খুঁজতে।
একজন তদন্ত কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'ওরা শুধু ভিক্ষা চায় না, ঘরে ঢোকার অজুহাত খোঁজে। পানি খেতে চায়, হাত ধোয়ার অনুরোধ করে বা বাথরুমে যেতে চায়। এই সুযোগেই ওরা গৃহবধূর অবস্থান, অলংকার ও ঘরের নিরাপত্তা দেখে নেয়। এরপর পরিকল্পিতভাবে চুরি করে।'
এই নারীচক্রের সদস্যরা একে অপরকে 'আপা' বা 'মা' বলে ডাকে, যাতে সন্দেহ কম হয়। অপরিচিত এলাকায় গেলে স্থানীয় মসজিদ বা দোকানে বসে ভিক্ষা করে, এবং নজরদারি চালায়।
পুলিশের একাধিক সূত্র বলছে, সারাদেশে এই ধরনের নারীচক্র সক্রিয় রয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নরসিংদী, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় একই কায়দায় নারী ভিক্ষুক সেজে চুরি বা প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে।
ভুক্তভোগীদের মতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে টার্গেট হন একা থাকা নারী, বিশেষ করে যাদের স্বামী প্রবাসে।
স্থানীয় শিক্ষক আবদুল গফুর বলেন, আমাদের এলাকায় আগে কখনও এভাবে ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে চুরি হয়নি। গত কয়েক মাস ধরে দেখি অপরিচিত কিছু নারী এসে বাড়ি বাড়ি ঘোরে, কেউ পানি চায়, কেউ একটু বসে বিশ্রাম নেয়। আমরা ভেবেছিলাম ওরা সত্যিই অসহায় মানুষ। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে— ওরা তথ্য সংগ্রহ করত, কার বাড়িতে কে থাকে, কে প্রবাসে আছে, এসব জেনে পরে পরিকল্পনা করত। এই ঘটনাটা আমাদের চেতনায় নাড়া দিয়েছে। এখন মানুষ ভয় পেয়ে গেছে— কেউ অপরিচিত কাউকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না।
রামুর ফকিরা বাজারের ব্যবসায়ী হাবিব বলেন, এটা নতুন ধরনের প্রতারণা। আগে ডাকাতি মানে রাতে অস্ত্র নিয়ে আসা, এখন দিনে দিনে দরজায় করুণা চেয়ে অপরাধ ঢুকে পড়ে। আমাদের সমাজ এতটাই দয়ার জায়গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যে অপরাধীরাও জানে— মানুষ এখন আর সন্দেহ করে না, দয়া করে। এই মনোবৃত্তিই ওরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিক সহানুভূতি ও করুণার জায়গাটাকেই এই চক্রগুলো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। মানুষ ভিক্ষুককে ঘৃণা নয়, দয়া করে— আর সেই দয়ার সুযোগ নিয়েই ঘটছে ভয়াবহ অপরাধ।
অপরাধ বিশ্লেষক ও সমাজ গবেষকরা বলছেন, ভিক্ষা ও সহানুভূতির আড়ালে গড়ে উঠছে এক ভয়ংকর প্রতারণা নেটওয়ার্ক। তাদের মতে, স্থানীয় প্রশাসনকে প্রত্যেক এলাকায় অস্থায়ী ভিক্ষুকদের তালিকা রাখতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে কেউ অপরিচিত ব্যক্তিকে একা ঘরে ঢুকতে না দেয়। সন্দেহজনক চলাফেরা দেখলে স্থানীয় পুলিশকে তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে হবে।
মানুষের করুণা যেখানে একসময় মানবতার প্রতীক ছিল, আজ সেটাই হয়ে উঠছে অপরাধীদের ছদ্মবেশ। ভিক্ষার থালা হাতে ঘুরে বেড়ানো এই নারীচক্র কেবল গয়না নয়— চুরি করছে সমাজের বিশ্বাস, মানবতার মায়া আর নিরাপত্তার অনুভূতি।
পেকুয়া থানার ওসি মোহাম্মদ সিরাজুল মোস্তফা বলেন, 'ভিক্ষার আড়ালে এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে চুরি ও প্রতারণা চালিয়ে আসছিল। নারী সদস্য হওয়ায় তারা খুব সহজেই বসতবাড়িতে প্রবেশ করতে পারত। সুযোগ পেলেই গৃহবধূদের অজ্ঞান করে স্বর্ণালংকার, টাকা-পয়সা লুট করে পালাত।'
গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে কিছু স্বর্ণালংকার, ঘুমের ওষুধ ও নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর