পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ হোসেন হত্যার ঘটনায় পুলিশের দেওয়া বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে তাঁর ছাত্রী বার্জিস শাবনাম বর্ষার পরিবার। জোবায়েদ হোসেন বাসায় গিয়ে বর্ষাকে পড়াতেন।
বর্ষার বাবা মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন ও মা আনিকা রহমান গতকাল শনিবার (২৫ অক্টোবর) বলেন, ‘বর্ষা যদি তার স্যারকে হত্যা করাবে, তাহলে কি নিজের বাড়ির মধ্যে করাবে? আর জোবায়েদের সঙ্গে যদি বর্ষার প্রেমের সম্পর্ক থাকত, তাহলে বর্ষা কেন মাহিরকে দিয়ে স্যারকে হত্যা করাবে? আবার মাহিরের জন্য স্যারকে হত্যা করালে পুলিশের কাছে কেন মাহিরের নাম শুরুতেই বলবে?’
গত ১৯ অক্টোবর টিউশনি করতে গিয়ে ছাত্রীর বাসার সিঁড়িতে খুন হন জোবায়েদ। বংশাল থানায় মামলা করেন জোবায়েদের বড় ভাই। ওই দিনই বর্ষা, মাহির রহমান এবং মাহিরের বন্ধু আলাইনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। খুনের ঘটনাকে পুলিশ ‘ত্রিভুজ প্রেমের বলি’ বলে উপস্থাপন করেছে। বর্ষা ও মাহির এক মাস আগে এই হত্যার পরিকল্পনা করে বলে দাবি করেছে পুলিশ।
পুলিশের বলা ত্রিভুজ প্রেমের বিষয়টি অসত্য দাবি করে বর্ষার মা বলেন, স্যারের (জোবায়েদ) কাছে যদি বর্ষা পড়তে না চাইত বা স্যার তাকে খারাপ কোনো কথা বলত; এর জন্য তো আর তাকে মেরে ফেলতে হয় না। আমি স্যারকে পড়াতে আসতে নিষেধ করে দিলেই তো আর আসত না।’
বর্ষার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে মিথ্যা ও অযৌক্তিক দাবি করেছেন তার মা-বাবা। খুনের সময় বর্ষা উপস্থিত ছিল এবং বর্ষার কাছে জোবায়েদ বাঁচার আকুতি জানায়– পুলিশের এই বক্তব্যকে সম্পূর্ণ অসত্য দাবি করেন বর্ষার মা। তিনি বলেন, ‘আমি সারাদিন বাসায় ছিলাম এবং বর্ষাও বাসা থেকে সারাদিন বের হয়নি। ঘটনার একটু আগে আমি ওকে (বর্ষা) ভাত খাওয়াচ্ছিলাম। এর ওপর আর কোনো সত্যি নাই।’ তিনি বলেন, “জোবায়েদ খুন হওয়ার খবর শুনে আমরা বাসা থেকে নামি। আমি আগে নামি, আমার মেয়ে পরে নামে। বর্ষা নিচে নেমে যখন জোবায়েদকে দেখে, তখন সে ‘স্যারকে মেরে ফেলেছে, স্যারকে মেরে ফেলেছে’ বলে চিল্লাচ্ছিল।”
পুলিশের আরেকটি বক্তব্য উল্লেখ করে বর্ষার মা আনিকা রহমান বলেন, ‘পুলিশ বলেছে, বর্ষা গহনা বিক্রি করে মাহিরকে গাড়ি কিনে দিয়েছে। গহনা বেচলে বর্ষা তো আমার গহনাই বেচবে। কিন্তু আমি তো আমার গহনা ঘরে রাখি না। আমার মেয়ে এত বড় ঘটনা ঘটালে আমি কি ওকে শাসন করতাম না?’
গত ২১ অক্টোবর ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ জানায়, বর্ষা ও মাহিরের ৯ বছরের প্রেমের সম্পর্ক।
পুলিশের এই দাবি ঠিক নয় বলছেন বর্ষার মা। তিনি বলেন, ‘মাহির আমাদের বাসার পাশেই ভাড়া থাকত। ছোটবেলা থেকে ওরা পাশাপাশি বড় হয়েছে। একই বয়সের দুইটা বাচ্চা হওয়াতে স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলত। ৯-১০ বছরের বাচ্চারা কি আর প্রেম বুঝে? তবে বড় হওয়ার পর বর্ষাকে ওর সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করি। এর মধ্যে মাহিররা এখান থেকে চলে যায়।’ তবে তিনি বলেন, ‘ওদের মধ্যে সম্পর্ক যদি থাকেও তা এক-দেড় বছরের হতে পারে। ৯ বছর নয়।’
বর্ষার মা আনিকা রহমান বলেন, ‘মাহির ছেলে হিসেবে ভালো ছিল না। তার সম্পর্কে আশেপাশে মানুষের নানা অভিযোগ ছিল। সে উচ্ছৃঙ্খল ছিল। এ জন্য আমরা চাইতাম না মেয়ে ওই ছেলের সঙ্গে কথা বলুক।’
পুলিশের দাবি, জোবায়েদ ও বর্ষার মধ্যে তিন মাসের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এ বিষয়ে বর্ষার মা বলেন, ‘জোবায়েদ স্যার ও বর্ষার মধ্যে কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। জোবায়েদ স্যার ছিল বর্ষার আইডল (আদর্শ)। এর বেশি কিছু কখনও দেখিনি। কখনও শুনিনি। জোবায়েদ অনেক ভালো ছিল, ভালো ছাত্র ছিল। এ জন্য স্টুডেন্ট হিসেবে সে স্যারকে পছন্দ করত– এতটুকুই। আমি বা বর্ষার বাবা জোবায়েদের মধ্যে কখনও খারাপ কিছু দেখিনি।’ তিনি বলেন, ‘প্রতি মুহূর্ত জোবায়েদের চেহারা চোখের সামনে ভাসে। আমরাও তো শোকাহত। আর আমাদের বাড়িতে ঘটনাটা ঘটেছে।’
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ জানিয়েছিল, বর্ষা ও মাহির পরিকল্পিতভাবে জোবায়েদকে খুন করেছে। বর্ষার মা বলেন, জোবায়েদ স্যারের পড়ানো ধরন বর্ষার পছন্দ ছিল। সে কেন তার টিচারকে খুন করাবে? আর যদি খুন করাত তাহলে কি বাসায় খুন করাত? তিনি বলেন, পুলিশ যখন কথা বলার জন্য এসেছিল, তখন বর্ষা মাহিরের নামটাই আগে বলেছে। কারণ বর্ষার কাছে মনে হয়েছে, মাহির এটা (খুন) করতে পারে। কিন্তু বর্ষা মাহিরকে খুন করতে দেখেনি। মাহিরের সঙ্গে পরিকল্পনা করে যদি বর্ষা খুন করাত, তাহলে কি মাহিরের কথা পুলিশকে শুরুতেই বলত?
বর্ষার মা বলেন, আমরা চাই জোবায়েদের খুনের বিচার হোক। কিন্তু আমার বাচ্চাটাকে যেন ফাঁসানো না হয়। আমার মেয়েটা এই খুনের সঙ্গে জড়িত না।’
ফোনে লোকেশন পাঠানোর বিষয়ে বর্ষার মা বলেন, ‘বর্ষা স্যারকে ফোন করে ৪টা ১০-এর দিকে। জোবায়েদ ৪টা ৩০ মিনিটের পড়াতে আসত। স্যার আসছে কিনা ও কতদূর আসছে–এটা জানার জন্য আগেও ফোন দিয়েছে। রেগুলারই তো দেয়। আর ওই দিন স্যার নিজেই তাঁর লোকেশন শেয়ার করে বলেছেন, তুমি দেখে নাও আমি কোথায় আছি। ওই লোকেশন যে বর্ষা কারও সঙ্গে শেয়ার করেনি তা তো তার ফোন চেক করলেই পাওয়া যাবে।’
তাহলে মাহির কেন জোবায়েদ খুন করলেন– এই প্রশ্নর জবাবে বর্ষার মা বলেন, ‘স্যার যে বর্ষাকে পড়াত, এটা পছন্দ করত না মাহির। বিষয়টা বর্ষা গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আমাকে জানায়। সেই ক্ষোভ থেকে মাহির এটা করতে পারে।’
বর্ষার বাবা গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘পুলিশ বলেছে, বর্ষা পরিকল্পনা করে স্যারকে খুন করিয়েছে। পুলিশ সত্যটা বলেনি। বর্ষা এই হত্যা সম্পর্কে কিছুই জানত না। পুলিশ বর্ষাকে মারধর করে বা ভয় দেখিয়ে হয়তো স্বীকারোক্তি নিতে পারে।’
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর