 
          
 
২০১৮ সালে সুন্দরবনকে 'দস্যুমুক্ত' ঘোষণা করা হলেও, ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর থেকে নতুন করে বনদস্যুদের উত্থান ঘটেছে।
অপহরণ, মুক্তিপণ ও নির্যাতনের ভয়ে উপকূলীয় জেলে ও বনজীবীদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পুরোনো ও নতুন গোষ্ঠী মিলে প্রায় ২০টি দস্যুবাহিনী বর্তমানে সুন্দরবনে প্রভাব বিস্তার করছে।
বিশেষ করে পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের মরা ভোলা, আলী বান্দা, ধঞ্চে বাড়িয়া, টিয়ার চর এলাকায় তাদের দৌরাত্ম্য চরম, যার কারণে উপকূলের অর্থনীতি বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে।
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বেলাল হোসেন মিলন জানিয়েছেন, ২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন জেলখানার বন্দী, চিহ্নিত অপরাধী, দাগী আসামি ও অনেক আত্মসমর্পণকারী বনদস্যু জেল থেকে অস্ত্রসহ পালিয়ে যায়। যাদের মধ্যে অনেকে বর্তমানে সুন্দরবন চষে বেড়াচ্ছে। তিনি দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে দ্রুত যৌথ অভিযান পরিচালনার দাবি জানিয়েছেন।
মৎস্য ব্যবসায়ী ও জেলেদের সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাওয়া তিন শতাধিক জেলে বনদস্যুদের হাতে আটক, অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত সেপ্টেম্বরে শতাধিক জেলেকে জিম্মি করে বনদস্যুরা।
এর মধ্যে অনেকেই মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করে ফিরে এসেছেন। এখনও বিভিন্ন বাহিনীর হাতে জেলেরা জিম্মি আছেন বলে জানান মৎস্য ব্যবসায়ীরা। পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের মরা ভোলা, আলী বান্দা, ধঞ্চে বাড়িয়া, তেঁতুল বাড়িয়া, টিয়ার চর, আন্ধারমানিক, পশুর, শিবশাসহ বিভিন্ন এলাকায় জলদস্যুদের বিচরণ বেশি।
দস্যুরা বিভিন্ন নামে দল গঠন করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আগের আত্মসমর্পণকারী বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ব্যক্তি এবং বিভিন্ন মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এসব দল। এসব বাহিনীর মধ্যে জাহাঙ্গীর বাহিনী, মনজুর বাহিনী, দাদা ভাই বাহিনী অস্ত্র ও সদস্য সংখ্যায় বেশি এবং দুর্ধর্ষ।
এই তিন বাহিনীর সদস্যরা আগে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়েছিল। এছাড়া করিম-শরিফ বাহিনী, আসাদুর বাহিনী, দয়াল বাহিনী, রবি বাহিনী, দুলাভাই বাহিনী, রাঙ্গাবাহিনী, সুমন বাহিনী, আনোয়ারুল বাহিনী, হান্নান বাহিনী ও আলিফ বাহিনীর নামও উল্লেখযোগ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বনসংলগ্ন এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দস্যুদের মধ্যস্থতাকারী ও সোর্স হিসেবে কাজ করছেন। তারা অপহৃত হয়ে জিম্মি থাকা জেলেদের পরিবার ও তাদের মহাজনদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে আদায়কৃত টাকা দস্যু বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শরণখোলার একাধিক মাছ ব্যবসায়ী জানান, দস্যুদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা নিরাপদ নয়। বনের পাশে জেলে মৎস্য আড়তের আশেপাশে দস্যুদের প্রতিনিধি বা সোর্স ঘোরাফেরা করে। তথ্য ফাঁসের বিষয়ে জানতে পারলে পরবর্তীতে বনে গেলে জেলেদের উপর বাড়ে নির্যাতন ও চাঁদার অঙ্ক। এই ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে জেলে বা মহাজন কেউই মুখ খুলছেন না।
ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, বনে জেলেদের পাঠালে নৌকা প্রতি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। অপহরণের ঘটনায় মুক্তিপণ হিসেবে দিতে হয় ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা।
কোস্টগার্ড মংলা পশ্চিম জোনের স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আবরার হাসান বলেন, ২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে সুন্দরবনের দস্যুদের উৎপাত শুরু হয়েছে। এরপর থেকে নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি বিশেষ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। দস্যু দমনে অভিযান এবং তাদের অবস্থান সনাক্তকরণে গোয়েন্দা বিভাগ কাজ করছে।
গত তিন অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় ২৭টি অভিযান পরিচালনা করেছে কোস্টগার্ড। এতে বাহিনী প্রধানসহ ৪৪ জন বনদস্যু এবং তাদের সহযোগীদের আটক করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে দেশি-বিদেশি ৪০টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৪৩টি বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্র, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম, ১৭০ রাউন্ড তাজা কার্তুজ ও ৩৬৯টি ফাঁকা কার্তুজ। বনদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা ৪৮ জেলেকে উদ্ধার করে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ বাগেরহাটের বিভাগীয় কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনে যেভাবে দস্যুদল হানা করতে শুরু করেছে তাতে শুটকি মৌসুমে দুবলাসহ বিভিন্ন চরে তাদের নির্ধারিত রেভিনিউ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে, তা ব্যাহত হতে পারে। তিনি দস্যু দমনের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন মহলকে অবহিত করেছেন।
মুনতাসির/সাএ
 সর্বশেষ খবর
  জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর