আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণভোটের আয়োজনও করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)। ইতোমধ্যে মাঠ কর্মকর্তাদের সকল ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছে ভোট আয়োজনকারী সাংবিধানিক এ সংস্থাট।
শনিবার (১৫ নভেম্বর) নির্বাচন ভবনে ইসি সচিবালয়ের মাসিক সমন্বয় সভা মাঠ কর্মকর্তাদের এমন নির্দেশনা দিয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্র।
বৈঠক সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার সরকার থেকে ঘোষণা আসার পর পরই আমরা প্রস্তুত ছিলাম এমন সিদ্ধান্ত আসবে। আজ আমাদের সকল ধরনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। প্রাক-নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসাবে জেলা ও উপজেলার সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে সভা আয়োজন করে তা দ্রুত শেষ করতে হবে। এছাড়া যেসব ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা আছে সেগুলোর তালিকা দ্রুত তৈরি করে কমিশনে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইসি কর্মকর্তা জানান, এখন যেহেতু সংসদ ভোট ও গণভোট একসঙ্গে হচ্ছে এর জন্য জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যে গণভোটের প্রসঙ্গ এলে পরিকল্পনায়ও সমন্বয় আনতে হবে। এর আগে দেশে তিনটি গণভোট হয়েছে (১৯৭৭, ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সাল) তবে কখন জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোট হয় নি। এবার হচ্ছে এজন্য সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির সঙ্গে ভোটকক্ষ বাড়ানো, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাড়ানো, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ আর ভোটার সংখ্যা অনুপাতে ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্সসহ সরঞ্জামাদি বাড়াতে হবে। প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের বিষয়টিও রয়েছে।
গণভোটের অতিরিক্ত ব্যয়ের কথা উল্লেখ করে এ কর্মকর্তা বলেন, যদি একসঙ্গে দুটি ভোট না হতো তাহলে সংসদ নির্বাচনে যেমন ব্যয় হয়। তেমনিই ব্যয় গণভোটেও হতো। তবে এখন এ ব্যয় ২০ শতাংশের মতো বৃদ্ধি পাবে।
গত বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, , “আমরা সকল বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটের আয়োজন করা হবে। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের মতো গণভোটও ফেব্রুয়ারির প্রথমার্থে একইদিনে অনুষ্ঠিত হবে।
একই দিনে দুই ভোট করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, তাতে “নির্বাচন আরও উৎসবমুখর ও সাশ্রয়ী হবে। গণভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে উপযুক্ত সময়ে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে।”
প্রধান উপদেষ্টা যখন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে এমন ঘোষণার পর বিকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ এএমএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, “আমরা ফরমালি বিষয়গুলো জানলে তখন আমরা এক্সেরসাইজ করে আমরা সব বসে কমিশনে আলাপ আলোচনা করে একটা মতামত দিতে পারবো।এ বিষয়ে এ মুহূর্তে কোন মতামত দেওয়া যথার্থ হবে না।”
দুই ভোট একসঙ্গে কর্মযজ্ঞ হবে দিগুণ
চলতি বছরের ডিসেম্বর তফসিল ঘোষণা করে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট গ্রহণ করবে ইসি। সংসদ নির্বাচন ১২ কোটি ৭৬ লাখের বেশি ভোটার সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে গণভোট ও সংসদ নির্বাচনের
ব্যালট পেপার মুদ্রণ করতে হবে সংস্থাটিকে। এছাড়া
প্রায় ৪৩ হাজার ভোটকেন্দ্রে প্রায় ২ লাখ ৪৫ হাজার ভোটকক্ষ থাকবে। তবে গণভোটের কারণে ভোটকক্ষ বাড়াতে হতে পারে। এছাড়া ৯-১০ লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা আর ৭-৮ লাখ আইন শৃঙ্খলাবাহিনী নিয়োজিত থাকবে ভোটে।
ইতোমধ্যে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে শেষ ধাপের সংলাপ চলছে। আইন-বিধি সংশোধন হয়ে গেছে। এখন গণভোটের জন্যও বিধি তৈরি করছে নির্বাচন কমিশন।
জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি তুলে ধরে গত বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, “আজকে একটা গণভোটের ইস্যু আসলো, সেটাও কিন্তু আমাদের মাথায় আনতে হয়েছে কয়েকদিন আগে থেকে। সব কিছু মিলে আমার প্রথম দরকার ছিল রাজনীতিবিদদের সাথে বসা। সার্বিক পরিস্থিতিতে আমরা সুযোগ নিতে পারি নি।..এখন পযন্ত কোনো প্রতিবন্ধকতা দেখছি না। ইসি আশাবাদী, রাজনৈতিক দলের নেতা ও প্রার্থীরা সহযোগিতা করলে সুন্দর নির্বাচন সম্ভব।”
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার প্রসঙ্গ টেনে এ নির্বাচন কমিশনার জানান, অনেকে সংলাপে সিডিউল কবে ডিক্লেয়ার হবে তারিখটা যেন আমরা বলি। আমরা মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যটা শুনি নি। আমরা শুনে পরে (প্রতিক্রিয়া) মনে হয় সময় এসেছে এটা ঘোষণা করার। সেটা ইনশাহআল্লাহ আমরা দেখব।”
একদিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট: লোকবল ও প্রশিক্ষণ বাড়ানোই প্রধান চ্যালেঞ্জ
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য এবং নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেছেন, সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হলেও কার্যকর প্রস্তুতি, লোকবল বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারলে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করা সম্ভব।
তিনি বলেন, “ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা বাড়ানোর পাশাপাশি গণভোট ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভালো প্রশিক্ষণের বিষয় রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। ১৯৮৫ ও ১৯৯১ সালের গণভোটে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, ভোটকক্ষ বাড়িয়ে দিলে একইদিনে দুটি ভোট সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যায়। কেন্দ্র না বাড়ালেও চলবে। তবে ব্যালট গণনায় দুই সেট লোকবল লাগবে—একটি সংসদ নির্বাচনের ব্যালট গণনা করবে, অন্যটি গণভোটের হ্যাঁ-না ব্যালট গণনা করবে।”
গণভোটের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ জরুরি
জেসমিন টুলী সাংবাদিকদের জানান, গণভোটের ক্ষেত্রে ব্যালট পেপার কীভাবে ইস্যু করতে হবে, কাউন্টিং কর্মকর্তারা কীভাবে গণনা করবেন—এসব নিয়ে বিস্তারিত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। প্রিজাইডিং কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের যখন ট্রেনিং দেওয়া হবে, তখন একই সময় আরও দুটি সেশন বাড়িয়ে গণভোটের প্রশিক্ষণ করা যেতে পারে। প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটেও দুটি ব্যালট ইস্যু করতে হবে। এগুলো চ্যালেঞ্জ নয়; বরং দায়িত্বের অংশ হিসেবেই করতে হবে।
ফেব্রুয়ারিতে দিন ছোট—ভোটের সময় বাড়ানো সম্ভব নয়
তিনি মনে করেন, ফেব্রুয়ারি মাসে দিনের দৈর্ঘ্য কম থাকায় ভোটের সময় বাড়ানো যাবে না। “সন্ধ্যার পরে নির্বাচন নেওয়ার ঝুঁকি আছে। অনেক এলাকায় বিদ্যুতের সমস্যা রয়েছে। তবে ভোটকক্ষ বাড়িয়ে দিলে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টার মধ্যেই ভোট সম্পন্ন করা যাবে,” বলেন তিনি।
বয়োবৃদ্ধ ও নিরক্ষর ভোটারদের ক্ষেত্রে সময় বেশি লাগতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেহেতু সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের ব্যালট বাক্স আলাদা হবে, তাই প্রক্রিয়াটি স্পষ্ট করে জানানো দরকার।
এবার সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রায় ২৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব রাখা হয়েছে। গণভোট আলাদাভাবে করলে একই ব্যয় ধারণা করা হয়েছিল। এখন সংসদ ও গণভোট একসাথে করলে ব্যয় সাশ্রয় হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর