সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় এরিয়া নিয়ে গঠিত পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ। সুন্দরবনকে বিশ্বের ঐতিহ্য হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারি ভাবে সুন্দরবনের ৭০% অভয়ারণ্য ঘোষণা করে। প্রাকৃতিক জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়।
তবে সরকারের এমন সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা নস্যাৎ করতে বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় অভয়ারণ্য এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সংরক্ষিত এলাকায় জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সাধারণের প্রবেশাধিকার সম্পূর্ণ নিষেধ থাকলেও মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে জেলে বাওয়ালিদের প্রবেশ করার সুযোগ করে দেয়। প্রবেশের সুযোগ করে নিতে জেলে বাওয়ালিদের দফায় দফায় মোটা অংকের টাকা দিতে হয় বন বিভাগকে। এই টাকা সংগ্রহ করতে জেলে বাওয়ালিরা জড়িয়ে পড়ছে সুদের সাথে।
একদিকে বনদস্যুর ভয়ে অন্যদিকে বন বিভাগের ঘুষ বাণিজ্যে অসহায় হয়ে পড়ছে জেলে বাওয়ালিরা। টাকা না দিয়ে অভয়ারণ্য প্রবেশ করলে সুনির্দিষ্ট বাহিনী (স্মাট প্রেট্রোলিং টিম)দিয়ে তাদেরকে আটক করে মোটা অংকের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগও উঠেছে বন বিভাগের বিরুদ্ধে।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তা মশিউর রহমানের ট্রেনিংয়ে থাকায় খন্ডকালীন দ্বায়িত্ব নিয়ে ফজলুল হক ছয় মাসের জন্য সাতক্ষীরা রেঞ্জে যোগদান করে। যোগদানের পর থেকে তার নেতৃত্বে ঘুষ নিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অভয়ারণ্যের অফিস গুলা। সাতক্ষীরা রেঞ্জের ৪টি স্টেশন বুড়িগোয়ালিনী, কোবাদক, কদমতলা ও কৈখালীর অধীনে ১২ টহল ফাঁড়ি রয়েছে এর মধ্যে ৬ টি টহল ফাঁড়ির অভয়ারণ্যের ভিতরে। খোলা বনে (সুন্দরবন)মাছ না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে অভয়ারণ্য প্রবেশ করতে হয় জেলেদের।
এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বন বিভাগের অফিসগুলোতে প্রতি গনে (১৫) দিন মাছের নৌকায় ফাঁস জাল ৮ হাজার, চরপাটা ১২ হাজার, খালপাটা ৫ হাজার, বরসি ৬ হাজার, কাঁকড়ার নৌকায় ৩ হাজার করে টাকা দিতে হয় অভয়ারণ্যের অফিস গুলোতে। এর বাইরে প্রতিটা স্টেশন থেকে সুন্দরবন প্রবেশের পাস (অনুমতি পত্র) করার পরেও অবৈধভাবে ডিউটি খরচের নাম করে হাতিয়ে নেয়া হয় প্রতি নৌকায় ৫শত টাকা।
এছাড়া যে এলাকা দিয়ে অভয়ারণ্য প্রবেশ করবে সেই এলাকার সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোকে লাইন খরচ দিতে হয় ১ হাজার টাকা, এ সকল ঘুষের টাকা গণের মাঝামাঝি সময় সংশ্লিষ্ট টহল ফাঁড়ির কর্মকর্তারা জেলেদের কাছ থেকে সরাসরি গ্রহণ করে থাকে। এই ঘুষ বাণিজ্যের বড় একটা অংশ সরাসরি পৌঁছায় সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তা ফজলুল হকের পকেটে। তথ্য অনুসন্ধান আরো জানা যায়, প্রতিটা স্টেশন থেকে গণপ্রতি ৫০ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। মাসে ৪টি স্টেশন থেকে প্রায় ৪ লাখ টাকা নিজের পকেটে ঢুকান ফজলুল হক। তার দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী ঘুষ বাণিজ্যের মোটা অংকের টাকা তাকে না দেয়া হলে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয় বন বিভাগ সদস্যদের। সম্প্রতি তার দেওয়া নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে না পারায় অভয়ারণ্যের কয়েকটা অফিসের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের প্রমোশন আটকানোসহ বিভিন্ন ভয় দেখানো হয় বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বনকর্মীরা।
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে তিনি কদমতলা ষ্টেশনের দ্বায়িত্বে থাকা কালীন বনকর্মী ও জেলেদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ আছে। সাতক্ষীরা রেঞ্জে মাছ ও কাকড়া মিলিয়ে সর্বমোট ২হাজার ৯শত বিএলসি আছে। এরমধ্যে মাছের বিএলসি রয়েছে ১৫ শত ও কাঁকড়ার বিএলসি রয়েছে ১৪ শত। এর অধিকাংশ জেলের অভয়ারণ্য প্রবেশ করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক জেলে জানান, খোলা বনে মাছ কাঁকড়া না পাওয়ায় আমরা মহাজনদের টাকা পরিশোধ করতে পারছি না, প্রতিনিয়তে ঋণে জড়িয়ে পড়ছি। ঋণ থেকে মুক্ত হতে হলে আমাদেরকে অভয়ারণ্য প্রবেশ করতে হয়। বনদস্যুর পাশাপাশি বন বিভাগকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুষ দিয়ে ঢুকতে হয়। পাস করে যাওয়া সত্ত্বেও বন বিভাগের প্রতিটা অফিসে ঘুষের টাকা দিতে হয়। প্রতিগণে মাছের নৌকা বাবদ ১৪ হাজার টাকার বেশি বন বিভাগকে দিতে হয়। প্রতি গনে যে মাছ পাই তাতে অনেক সময় খরচ উঠে না। কিন্তু বন বিভাগ ও বনদস্যুদের টাকা পরিশোধ করে তারপরে সুন্দরবনের প্রবেশ করতে হয়।
পরিবেশবিদ অধ্যক্ষ আশেক-এলাহী জানান, সুন্দরবন বিশ্বের ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান এখানে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার দায়িত্ব বনবিভাগের কিন্তু কিছু অসাধু বন কর্মকর্তারা নিজেদের অর্থনৈতিক সুবিধার কারণে অভয়ারণ্যে জেলেদের প্রবেশ করার সুযোগ করে দেয়। ফলে সুন্দরবনের অভয়ারণ্য এখন ধ্বংসের মুখে। আমরা দাবি জানাই এ সকল অসাধু বনকর্মকর্তাদের অপসারণ করে সুন্দরবনের অভয়ারণ্যকে রক্ষা করা।
সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তা ফজলুল হক বলেন, অভয়ারণ্যে জেলেদের অনুপ্রবেশ আমরা আন্তরিকভাবে কমাতে চাচ্ছি। এজন্য বিভাগীয় বন কর্মকর্তা(ডিএফও) স্যারের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেক অফিসকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে এই কঠিন মুহূর্তে টাকা লেনদেনের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অবান্তর। চিঠি দিয়ে জানানোর পরও অভয়ারণ্য এলাকায় খোলামেলাভাবে মৎস্য আহরণ করছে কিভাবে এমন প্রশ্নোত্তরে তিনি বলেন, সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ একটা বৃহৎ এলাকা জুড়ে অবস্থিত। এখানে বিশৃঙ্খল ঘটনা থাকবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের ডিপার্টমেন্টাল কিছু ব্যবস্থা চলতেছে। ইতিমধ্যে অনেককেই কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। যদি তারা সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারে তাহলে ভালো, না হলে সরাসরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কুশল/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর