কুমিল্লা মডার্ন হাইস্কুলে চলমান অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে বুধবার (২৬ নভেম্বর) দুপুরে জেলা প্রশাসকের বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন শিক্ষকরা। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুনের নিকট এই স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়।
জানা গেছে, কুমিল্লা মডার্ন হাইস্কুল দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের অন্যতম সেরা একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় এই বিদ্যালয় থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে থাকে। গত ৫ই আগস্ট ২০২৪ তারিখে দেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটার পর থেকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক অনুপস্থিত রয়েছেন। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নুসরাত জাহানকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
অভিযোগ উঠেছে, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুসরাত জাহানের প্রশাসনিক অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে কতিপয় খণ্ডকালীন শিক্ষক মো. আরিফুর রহমান, মো. আবু তাহের, মোসা. নাজমা আকারসহ কয়েকজন বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। একইসাথে তারা বিদ্যালয়ের অনেক আর্থিক অনিয়মের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালে প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষা ও অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় মোট ২২ লক্ষ ৪৮ হাজার ৪২৪ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে মাত্র ১৭ লক্ষ ৫০ হাজার ৩৭৬ টাকা শিক্ষক ও কর্মচারীদের মধ্যে পরীক্ষার সম্মানী বাবদ বন্টন করা হয় এবং অনুপস্থিত প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকের সম্মানী বাবদ ৬৫ হাজার টাকা বন্টন করা হয়। অবশিষ্ট ৪ লক্ষ ৩২ হাজার ৯৫০ টাকার কোনো হিসাব বা হদিস পাওয়া যায়নি।
এছাড়াও ২০২৪ সালের ৬ষ্ঠ শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১ লক্ষ ৩৪ হাজার ৬৪০ টাকা উত্তোলন করা হয়। যার মধ্যে ৮৩ হাজার ২৮ টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়া হলেও অবশিষ্ট ৫১ হাজার ৬১২ টাকার কোনো হদিস মেলেনি। একইভাবে, ২০২৪ সালের ৮ম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১ লক্ষ ৪৭ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়, যার মধ্যে ১ লক্ষ ৪৬ হাজার ৬২২ টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়া হলেও অবশিষ্ট টাকা এবং ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির মোট ২ লক্ষ ৩০ হাজার টাকার মধ্যে কম্পিউটার অপারেটরকে ২৬ হাজার ৫০০ টাকা দেওয়া হয়। বাকি ২ লক্ষ ৩ হাজার ৬৫০ টাকার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
২০২৪ সালের ৯ম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৫ লক্ষ ৭৬ হাজার ৮০০ টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে ৪ লক্ষ ৪১ হাজার ২৫২ টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়া হলেও অবশিষ্ট ১ লক্ষ ৩৫ হাজার ৫৪৮ টাকার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১২৬৫ জন। উত্তীর্ণ ১২৫০ জনকে প্রবেশপত্র বিতরণের জন্য ৩ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়, যার মধ্যে ৩ লক্ষ ৫৫ হাজার ৫০০ টাকার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
২০২৫ সালের ৬ষ্ঠ শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ২ লক্ষ ৪৩ হাজার ১০০ টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে ২ লক্ষ ২ হাজার ২১৫ টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়া হলেও অবশিষ্ট ৪০ হাজার ৮৮৫ টাকার মধ্যে কম্পিউটার অপারেটরকে ১০ হাজার টাকা এবং শ্রেণি শিক্ষকদের ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বাকি ২০ হাজার ৮৮৫ টাকার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
২০২৫ সালের ৮ম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৩ লক্ষ ৭৬ হাজার ৫০০ টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে ৩ লক্ষ ৩ হাজার ৬ টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়া হলেও অবশিষ্ট ৭৩ হাজার ৪৯৪ টাকার মধ্যে কম্পিউটার অপারেটরকে ১০ হাজার টাকা এবং শ্রেণি শিক্ষকদের ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বাকি ৫৩ হাজার ৪৯৪ টাকারও কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে মোট ১২ লক্ষ ২ হাজার ২৭ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুসরাত জাহানের বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে শিক্ষকরা জড়িতদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। একইসাথে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এই ঘটনার সাথে জড়িত থাকলে তাকে বহিষ্কারের দাবিও জানান তারা।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নুসরাত জাহান তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, “আমি কোনো টাকা আত্মসাৎ করিনি।”
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন জানিয়েছেন, এই কার্যক্রমের সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান ও শিক্ষকের মর্যাদা যেন ক্ষুন্ন না হয়, সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান তিনি।
এ সময় কুমিল্লা মডার্ন হাইস্কুলের সিনিয়র শিক্ষক মফিজুর রহমান নিজামী, আব্দুল কাদের, মনিরুল ইসলামসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
মাসুম/সাএ
সর্বশেষ খবর