বাংলাদেশে গত তিন দশকে ব্রয়লার বা পোল্ট্রি শিল্প উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। একসময় ঘরোয়া পর্যায়ে সীমিতভাবে হাঁস-মুরগি পালন হলেও এখন এটি দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদা পূরণে প্রধান বাণিজ্যিক খাতে পরিণত হয়েছে। তবে উৎপাদনের এই সাফল্যের পেছনে বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। খামারগুলোতে নিয়ন্ত্রণহীন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে মুরগির শরীরে তৈরি হচ্ছে মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া বা সুপারবাগ, যা মানুষের গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিককে অকার্যকর করে দিতে পারে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘এশিয়ান-অস্ট্রালাশিয়ান জার্নাল অফ ফুড সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি’র এক পর্যালোচনা গবেষণায় দেখা গেছে, পোল্ট্রি খামার থেকে সংগৃহীত ই. কোলাই নমুনার ৭৫ শতাংশের বেশি একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। গবেষণাটির নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, মুরগির অন্ত্রে পাওয়া গেছে ‘এমসিআর-১’ জিন, যা মানুষের জন্য জরুরি অ্যান্টিবায়োটিক কোলিস্টিনকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে।
দেশের মোট ব্রয়লার উৎপাদনের ৭০-৮০ শতাংশ আসে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের কাছ থেকে, যাদের অধিকাংশই ভেটেরিনারি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়াই ফিড ডিলার বা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের সুপারিশে মুরগিকে নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক দেন। ফলে সিপ্রোফ্লক্সাসিন, এনরোফ্লক্সাসিন ও টেট্রাসাইক্লিনসহ নানা ওষুধের অবশিষ্টাংশ মুরগির মাংসে পাওয়া যাচ্ছে। বাজার থেকে সংগৃহীত নমুনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২২ শতাংশ নমুনায় ফ্লোরোকুইনোলোন এবং ১৮ শতাংশে টেট্রাসাইক্লিনের অবশিষ্টাংশ রয়েছে।
নিয়মিতভাবে অল্পমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করলে অ্যালার্জি, অঙ্গ-প্রতঙ্গের বিষক্রিয়া, অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম নষ্ট হওয়া এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসের মতো দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা দেখা দিতে পারে।
এ শিল্প পরিবেশের জন্যও উদ্বেগ বাড়িয়েছে। একটি ব্রয়লার মুরগি জীবনচক্রে ১.৫ থেকে ২ কেজি বর্জ্য উৎপন্ন করে, যা দেশের মোট উৎপাদন হিসেবে বছরে বিপুল পরিমাণে জমা হচ্ছে। এসব বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় জমি বা জলাশয়ে ফেলায় পানি ও মাটির দূষণ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে ভূগর্ভস্থ পানি ও নদীনালায় নাইট্রেট ও ফসফরাসের মাত্রা বাড়ছে এবং অ্যামোনিয়া নির্গত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট মোকাবিলায় ‘ওয়ান হেলথ’ নীতি বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশ—এই তিনটি উপাদানের স্বাস্থ্য পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। গবেষকরা অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে প্রোবায়োটিক, প্রিবায়োটিক ও ভেষজ ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি খামারে বায়োসিকিউরিটি জোরদার করা, সঠিক টিকাদান নিশ্চিত করা, অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয়ে কঠোর নীতি গ্রহণ এবং নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
গবেষণার প্রধান লেখক অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বলেন, ব্রয়লার শিল্প প্রোটিনের চাহিদা পূরণে ও কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রাখলেও নিয়ন্ত্রণহীন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে পুরো শিল্পই ঝুঁকিতে পড়তে পারে। তিনি বলেন, এখনই সচেতনতা ও সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সাজু/নিএ
সর্বশেষ খবর