লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মুখ দেখে বাংলাদেশ। নয় মাস বুকে জমে থাকা পাথর সরিয়ে আনন্দের ঝিলিক দেখা দেয় সবার মাঝে। চারদিকে আনন্দ-উল্লাস। প্রিয় লাল-সবুজের পতাকায় ছেয়ে যায় গোটা দেশ। জীবন বাজি রেখে পাহাড়-পর্বত আর বন-বাদাড়ে ঘুরে ফেরা সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গন থেকে ফেরে প্রিয় স্বজনের কাছে। কষ্টে অর্জিত বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা হয় চারপাশ।
তবে এমন দিনেও আনন্দ ছিল না দেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্মভূমি কিশোরগঞ্জে। বিজয়ের দিনেও হাসতে পারেনি কিশোরগঞ্জের মানুষ। কিশোরগঞ্জ শহরে সেদিন উড়ছিল পাকিস্তানি পতাকা। শহরের নিয়ন্ত্রণ ছিল রাজাকার-আলবদরদের হাতে। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় স্বাধীনতাবিরোধীরা। ১৭ ডিসেম্বর বিজয়ের স্বাদ পায় কিশোরগঞ্জবাসী। পাক হানাদার বাহিনী কিশোরগঞ্জ ছেড়ে যায় ১২ ডিসেম্বর। কিন্তু শহরে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে অবস্থান নেয় রাজাকার-আলবদর বাহিনী। ফলে কিশোরগঞ্জকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদল কিশোরগঞ্জ শহরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। পরিস্থিতি বেসামাল দেখে রাজাকার বাহিনী বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়।
১৬ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযুদ্ধের কোম্পানি কমান্ডার কবীর উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা ড. মাসুদুল কাদের, প্লাটুন কমান্ডার দিলীপ সরকারসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল করিমগঞ্জ থেকে কিশোরগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে সতাল এলাকায় এসে অবস্থান নেন। অবস্থা বেগতিক দেখে অধ্যাপক জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও আজিমউদ্দিন হাইস্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক হেলাল উদ্দিনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে বলে খবর পাঠায় রাজাকার বাহিনী।
১৭ ডিসেম্বর সকালে একটি খোলা জিপে করে মুক্তিযোদ্ধা কবির উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র দল কিশোরগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। শহরের পুরানথানা শহীদী মসজিদ সংলগ্ন ইসলামীয়া ছাত্রাবাস মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে রাজাকার-আলবদর বাহিনী। একই সময়ে শহরের চারদিকে অবস্থানকারী অন্য মুক্তিযোদ্ধারা শহরে এসে প্রবেশ করে। এ সময় জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো শহর। মুহূর্তেই এ আনন্দবারতা ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।
সাবেক এমপি মুক্তিযোদ্ধা কবীর উদ্দিন আহমেদ বলেন, কিশোরগঞ্জ জেলার অনেক এলাকা আগেই মুক্ত হলেও এসব এলাকার রাজাকাররা শহরে এসে ঘাঁটি করে। কিশোরগঞ্জ মুক্তকারী মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আব্দুল গনি বলেন, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের নিজের জেলা হওয়ায় স্বাধীনতাবিরোধীরা কিশোরগঞ্জ শহরকে টার্গেট করেছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বার সাহসিকতায় তারা শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেনি।
এভাবেই বিজয় দিবসের একদিন পর ১৭ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের আকাশে ওড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।
মাসুম/সাএ
সর্বশেষ খবর